ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর নীতি’ এনআরসির জন্য দায়ী

মো. হাসান তারেক
মো. হাসান তারেক

ভারতের আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ইস্যুতে উত্তেজনা চলছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গেও। গত ৩১ আগস্ট আসামে নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর বাস্তুচ্যূত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন ১৯ লক্ষ ৬ হাজার মানুষ। যদিও খোদ শাসক দল বিজেপির অনেক নেতা এই নাগরিক পঞ্জির অনেক ভুল-ভ্রান্তি নিয়ে অভিযোগ করেছেন।

আসামের এই অবস্থার মধ্যেই ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিক পঞ্জি হবেই বলে দাবি করেছেন। তাদের এই ঘোষণার পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এবং আশঙ্কায় পড়ে গেছেন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ জনগণ।

বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছেন, আসাম ধাঁচে পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হবে। তাতে প্রায় দু’কোটি মানুষ বাদ যাবে। অপরদিকে, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি রুখতে রাজপথে নেমেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা। তিনি বলেছেন, ২ কোটি কেন, ২ জনের গায়ে হাত দিন।

তিনি আরো অভিযোগ করে বলেছেন, আসামে যে ১৯ লক্ষ মানুষ এনআরসিতে বাদ পড়েছেন তার মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু রয়েছেন। ১৯ লক্ষ মানুষের মধ্যে রয়েছেন বৌদ্ধ, মুসলিম ও গোর্খারাও।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিজেপি সরকার দিল্লি, তেলেঙ্গানাসহ সারা ভারতে নাগরিক পঞ্জি তৈরীর পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করছে। অভিযোগ আছে, সামনে বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য বিজেপি সরকার এমনটি করছে। হিটলার থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পরাও এই সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করেছেন।

তবে জনপ্রিয়তা অর্জনের সাময়িক এই পন্থা রাষ্ট্রের জন্য, বিশ্বের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির কারণ হয়। যার উজ্জ্বলতম নিদর্শন হচ্ছে চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকারের নাজুক অবস্থা। মোদি সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের একটি মুখ্য বিষয়ও ছিল এই এনআরসি। ক্ষমতায় এসেই বিজেপি সরকার এই নিয়ে কাজ শুরু করল। তবে, এটি ভারতে যে বিভাজনের এবং অস্থিতিশীলতার রাজনীতির শুরু করলো তা এখন স্পষ্টত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

এনআরসি নিয়ে যে জটিলতার সূত্রপাত হয়েছে তার জন্য মুখ্যত দায়ী হচ্ছে ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর নীতি’। ধর্মীয় বিভাজনেরও সূত্রপাত ভারতীয় উপমহাদেশে করেছিল এই ব্রিটিশরা। ১৮৭৪ সালে আসামকে বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করার সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত কাছাড় প্রদেশকে আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতে জীবিকা ও জমির সন্ধানে আসাম প্রদেশে চলে আসা নাগরিকদের ক্ষেত্রে যে নীতি ব্রিটিশরা নেয়, তা একদিকে নিশ্চিত করেছিল ব্রিটিশদের মুনাফা, অন্যদিকে অসমীয়া ও বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ তৈরি বজায় রেখেছিল ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠে। ব্রিটিশদের এই সকল ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা ও মুনাফাবাদী নীতির বর্তমানে বলি হতে চলেছে এই ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর সংকটের উৎসের সন্ধান করতে গেলেও একই চিত্র পরিলক্ষিত হয়।

ভারতে যখন মুসলামনদের সংখ্যা বাড়ছে তখন শঙ্কায় পড়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি। নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে তারা আশ্রয় করতে চাইছে ইতিহাসের এই দায়ভারকে।

বিজেপির এই নাগরিক পঞ্জি সংক্রান্ত উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ‘অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ তথা আসু। ‘অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ এনআরসি জন্য দীর্ঘ ছয়-সাত বছর আন্দোলন করেছিল। তাদের আন্দোলন একসময় বাঙালি বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৩ সালে নেলিতে লালুং উপজাতির হাতে মৃত্যু হয় হাজারের অধিক বাঙালি মুসলমানের।

পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার ১৯৮৫ সালে ‘আসু’ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনায় বসে দিল্লি ও অসম কংগ্রেস সরকার সই করল ‘অসম অ্যাকর্ড’। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ এর পরবর্তী সময়ে যারা আসামে এসেছেন, তাদের আর ভারতীয় নাগরিক হিসাবে স্বীকার করা হবে না, থাকবে না ভোটাধিকার।

এই চুক্তি অনুযায়ী কংগ্রেস সে সময় নাগরিক পঞ্জি তৈরির উদ্যোগ না নিলেও বর্তমান বিজেপি সরকার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্য সেই উদ্যোগ এখন নিয়েছে। বিজেপি নাগরিক পঞ্জির পাশাপাশি এনেছে ‘সিটিজেন শিপ বিল’। এই বিলের আওতায় বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের মধ্যে যারা হিন্দু এবং ভারতে বাস করছেন ছয় বছরের বেশি তারা সকলেই ভারতে সরকারিভাবে ‘শরনার্থী’ হিসেবে থেকে যেতে পারবেন।

বিজেপি সরকারের এই নীতি শান্তিপ্রিয় ভারতবাসীর মনে মুসলিম বিরোধী মনোভাব চাঙ্গা করে তুলবে। বিজেপির এনআরসি সংক্রান্ত নীতি সারা ভারতে আতঙ্কের জন্ম যেমন দিয়েছে তেমিন সূত্রপাত হতে পারে সামনের দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার। যেখানে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বর্তমান বিশ্ব চিন্তিত তার মধ্যে এনআরসি সংকট এখন বাড়তি মাত্রা যোগ করতে পারে।

ভারতের উচিত হবে, জাতিসংঘের অভিবাসী সংক্রান্ত নীতিমালা ও জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা সংক্রান্ত নীতিমালার প্রতি আস্থাশীল থেকে বিভাজন থেকে দূরে থেকে ঐক্যের বন্ধন সুসংহত করা। কিন্তু অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীরা কোন পথে ভারতকে নিয়ে যাবে তা সময়েই বলে দিবে।

লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ডক্টর মালিকা কলেজ।