শোভন-রাব্বানীর দোষ কতটুকু ?

বর্তমানে দেশের অন্যতম আলোচিত বিষয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাখোশে’র খবরে একটি বিশেষ অংশ ছাত্রলীগ বা অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। অনেকটা বেকায়দায় পড়া শোভন-রব্বানীকে নিয়ে তার ঘরে বাইরে সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে।

কয়েকটি জাতীয় সংবাদ মাধ্যম অমুক দিন তমুক দিন ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব আসছে বলে সংবাদ প্রচার করছে। কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম তাদের দৈনিক সংস্করণে এ দুজনের ‘কুকর্ম’ তুলে সংবাদমাধ্যমটি আলোচনায় আসছে। তার সাথে যোগ হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একটি বক্তব্য ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে আলোচনা। জাবির সম্মানিত উপাচার্যের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে একটি অস্পষ্ট ব্যাপার তৈরি হয়েছে। যেটাকে চাঁদাবাজি বলে চালিয়ে নিয়ে দেশের বৃহত্তম ছাত্রসংগঠনের নেতাদের চরিত্রে কালিমালেপনের চেষ্টা চলছে।

আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি কখনো জড়িত না থাকলেও কাছ থেকে গত ৯ বছরে ছাত্রলীগের কমপক্ষে শতাধিক নেতাকে দেখেছি। সামান্য দূর থেকে এর আগের দুটি কমিটির নেতৃবৃন্দকে দেখেছি। আবার বর্তমান কমিটির দুই নেতাকে দেখছি। এই অস্পষ্ট সময়ে তাই কিছু লেখার প্রয়োজন বোধ করছি।

দীর্ঘ ৮ বছরের বেশি সময় ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার সাথে জড়িত থাকার কারনে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম, ধরন ও চরিত্র নিয়ে ব্যাপক জানাশোনার সুযোগ হয়েছে। সাংবাদিকতার খাতিরে এ দীর্ঘ সময় দায়িত্বে থাকা শীর্ষ নেতাদের সাথে কথোপকথন করার সুযোগ হয়েছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হওয়ায় সবগুলো ছাত্রসংগঠন নিয়ে জানা শোনার যে বিস্তৃতি হয়েছে তার আলোকে কয়েকটি কথা বলব। আসলে শোভন-রব্বানীর দোষ কতটুকু ?

২০১৮ সালের ৩১ জুলাই রাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে দুই বছরের জন্য ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছে গোলাম রাব্বানী। মে মাসের ১১ ও ১২ তারিখে ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় অধিবেশনের পর কমিটি ঘোষণার নিয়ম থাকলেও শীর্ষ পদের নেতৃত্ব বাছাইয়ে সময় নেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী ৩২৩ জনের জীবনবৃত্তান্ত বিভিন্ন মাধ্যমে যাচাই-বাছাইয়ের পর এসব নেতার অনেককেই গণভবনে ডাকেন প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ ১ যুগের বেশি সময় পর পর ‘সিন্ডিকেট’ এর হাত থেকে বের হয়ে নতুন আলো আসে ছাত্রলীগ। এভাবেই সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন হতে থাকে।

এবার আসি মূল আলোচনায় ? প্রথমত, কমিটি ঘোষণার পর শোভন-রব্বানীর কর্মকাণ্ডে বাহবা চলতে থাকে সর্বত্র। খটকা বাঁধে কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ ঘোষণার পর থেকে। মনঃপুত না হওয়ায় আস্তে আস্তে বের হতে থাকে নানান সমালোচনা। এখন প্রশ্ন হল এ ধরনের সমালোচনা কি এবারেই প্রথম? না এবারেই প্রথম না । যারা বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা বা গবেষণা করছেন তাদের কাছে বিষয়টি একেবারেই পরিষ্কার। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর অসন্তোষ হয়নি এমন ঘটনাকি আদৌ ঘটেছে? না তা তো হয়নি ! তাহলে বিষয়টি নিয়ে এত চিৎকার কেন? কারণ তাতে কয়েকজন ‘ডেডিকেটেড’ নেতাকর্মী বাদ পড়েছেন। তারা অনশন করেছেন। এবারতো প্রথম এমন হয়নি। তিন মাস পর কমিটি বৃদ্ধি করে তাদের যোগ্য পদে দিলে কি সমাধান হয় না ?

দ্বিতীয়ত, জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুনেতাকে চাঁদা দেয়া হয়েছে ইত্যাদি মর্মে যে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে গত দুদিন ধরে তার বিষয়ে আমার কয়েকটি কথা আছে। এ ধরনের চাঁদাবাজির সংবাদ কি এবারেই প্রথম? না তো । আর আদৌ এ ধরনের কোন কাজ হয়েছে কিনা তার কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু শতাধিক এ ধরনের সংবাদতো আগেও প্রকাশিত হয়েছে। এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নথি ঘাটলে এর হাজারটা প্রমাণ পাওয়া যাবে আমি নিশ্চিত। তখনতো সেসব নিয়ে এত প্রতিক্রিয়া দেখিনি। তাদের হঠাৎ এত প্রতিক্রিয়া কেন ? তখনতো কমিটি ভেঙ্গে নতুন নেতৃত্বেও কথা শোনা যায়নি।

তৃতীয়ত, কমিটি বাণিজ্য নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। স্বাধীনতার পর থেকে মেধাবীদের নেতৃত্বে চলে আসছিল এ ছাত্রসংগঠনটি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ স্যারের কাছ থেকে শুনতাম তখন নেতৃত্ব বাছাইয়ের পদ্ধতির কথা। (স্যার মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ভিপি ও ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন)। ক্লাশের ১ম ও ২য় দের নিয়ে তখন নেতৃত্ব বাছাই হত। মেধাবীরা করতেন ছাত্ররাজনীতি। যার সুফল এখন কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ।

এখন কথা হল- তাহলে এ কমিটি বাণিজ্য কথাটি কোথায় থেকে আসল ? এটাতো এবারেই প্রথম শোনা গেছে তা নয়। গত এক যুগের বেশি সময়ে ধরে কমিটি বাণিজ্যেও খবর দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোতে শিরোনাম হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন ঘাটলে আমি নিশ্চিত কয়েকশত এমন পাওয়া যাবে। তাহলে এবার এত আওয়াজ কেন ? এ কমিটি দেশরত্ন নিজের হাতে দিয়েছেন বলে?

কথা বেশি বড় করব না, রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বা গোলাম রব্বানী অন্য ৮-১০ জনের মত সাধারণ ছাত্র। তাদের আচরণে এমনটাই প্রকাশ পেয়েছে। তাদের ভুলক্রটি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আম চুরির জন্য যদি ফাঁসির আবেদন করলে আদালতে যেমন হাস্যরসে পরিণত হবে। ঠিক তেমনি লঘু এসব অভিযোগের দায়ে কাউকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার কথা উঠলে সেটাও সুবিবেচকদের কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হব।

আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে এ দুই নেতা নেত্রীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন । একটি অনলাইন পত্রিকার সংবাদ হুবহু তুলে ধরে বলব তাদের সংশোধনের সুযোগ দেয়া দরকার।  (এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভুল স্বীকার করে নেতারা বলেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গকরণসহ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতার একজনের কাছে দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে ‘মমতাময়ী নেত্রী’ সম্বোধন করে বলা হয়েছে- আপনি বিশ্বাস করে শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির যে পবিত্র পতাকা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, তার মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট ছিলাম। দায়িত্ব পালনের শুরু থেকেই চতুর্মুখী চাপ, সদ্য সাবেকদের অসহযোগিতা, নানা ষড়যন্ত্র, প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা আর আমাদের জ্ঞাত-অজ্ঞাত কিছু ভুল ইতিবাচক পরিবর্তনের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করেছে। আমাদের দায়িত্বশীল আচরণের ব্যর্থতা ও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির বাইরেও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, প্রিয় নেত্রী দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট ভেঙে আপনি নিজে পছন্দ করে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বলে আমরা একটি বিশেষ মহলের চক্ষুশূল। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে ও প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সুকৌশলে আপনার এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের কান ভারী করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। আপনার সন্তানরা এতটা খারাপ না। আমরা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি বারবার। অনেক অব্যক্ত কথা রয়েছে, যা আপনাকে বলার কখনও সুযোগ পাইনি। বিভিন্ন মাধ্যমে শ্রুত অভিযোগের ভিত্তিতে প্রকৃত সত্যটুকু উপস্থাপনের সুযোগ চাই।)

লেখক : সাবেক সভাপতি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।