ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যে চিরকুট!

বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অন্যতম মূল অনুষঙ্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৭ এ ভারত বিভক্তি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৭১ এ স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রতিটি পদক্ষেপে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ গোটা আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। সব সময় অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ বিদ্যাপীঠ। এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছিল জাতির জনক বঙ্গবল্পব্দু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক নেতাকে।

তবে, বাংলাদেশ সৃষ্টির পর কিছুটা পথ বিচ্যুত হয় এ বিশ্ববদ্যালয়। বর্তমান অবস্থা বেশ নাজুক। গত এক দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক কারণে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত হয়ে আসছে। এক সময়কার ন্যায় নীতির মূর্ত প্রতীক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন যৌক্তিক আন্দোলন ও দাবীর বিরুদ্ধে হাটছে। প্রতিনিয়ত নেতিবাচক কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় ও বাস্তবায়ন করে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২৮ বছর পর দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট খ্যাত ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিমাতাসুলভ আচরণ ঢাবির ইতিহাসে অনেকখানি কলঙ্ক যুক্ত করেছে।

এছাড়া, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনে হামলা, মামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটছে নিয়মিতই। সর্বশেষ ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ম না মেনে ভর্তি করিয়ে ডাকসু নির্বাচনে প্রতীদ্বন্দ্বীতা করার সুযোগ দেয়া এবং বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে তাদেরকে নির্বাচিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে অধ্যায়ের সূচনা করেছে তা সত্যিই লজ্ঝার। যেখানে ভর্তির জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার পাশাপাশি পূর্ববর্তী ফলাফল ও অভিজ্ঞতার বিষয়গুলো বিবেচিত হয়, সেখানে মাত্র চিরকুটের মাধ্যমে একটি বিশেষ সংগঠনের নেতাদের ভর্তি করিয়ে নেয়া কোনোভাবেই বৈধ্যতা পেতে পারে না। এক থেকে পাঁচ বছর আগে যাদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে তাদেরকে ডাকসু নির্বাচনের আগে পরীক্ষা ছাড়াই ভর্তি করিয়ে নেয়া যে বিশেষ উদ্দেশ্যেই হয়েছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

আর, চিরকুট বিনিময়ের অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বয়ং উপাচার্য ও সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনের বিরুদ্ধে। তাদের অনেককে ভর্তি করাতে চিরকুটের মাধ্যমে ডিনের কাছে সুপারিশ করেছিলেন উপাচার্য। সংবাদ মাধ্যমে এ ভর্তি প্রক্রিয়ার তথ্য উঠে আসার পর উপাচার্য ভর্তি প্রক্রিয়া সমন্ধে জানেন না বলে দায়ভার চাপিয়েছেন ডিনের উপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকগণসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ যখন এ ভর্তি প্রক্রিয়াকে অবৈধ বলে অবহিত করছেন, তখন সংবাদ সম্মেলন করে তা বৈধ দাবি করেছেন বিজনেস অনুষদের ডিন। তিনি বলেছেন, ইভিনিং প্রোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, এটা অনুষদের নিজস্ব প্রোগ্রাম। আসন খালি থাকা সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের সার্কুলারের বাইরেও ভর্তি করানোর সুযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে লিখিত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। তাছাড়া শিক্ষার্থীরা একবার লিখিত পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়েছে, দ্বিতীয়বার দেয়ার যৌক্তিকতা নেই। যদিও অতীতে তার এই যুক্তির ভিত্তিতে কাউকে ভর্তি করানো হয়নি।

পরীক্ষা ছাড়াই ছাত্রলীগের ৩৪নেতাকে ভর্তির ঘটনাকে অবৈধ বলে দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রদল, সাধারণ শিক্ষার্থী পরিষদসহ বিভিন্ন ত্রিক্রয়াশীল সংগঠন। এমনকি শিক্ষার্থীরা গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ও ডিন শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে। এই ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে টিআইবি। উত্থাপিত অভিযোগের ফলে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের ভর্তি প্রত্রিক্রয়া নিয়ে আস্থার সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে উল্লেখ করে এর মোকাবিলার জন্য সৎসাহসের সাথে অভিযোগ আমলে নিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।

শুধু ভর্তি প্রত্রিক্রয়াই অনিয়মের অভিযোগই নয়”, বিতর্কের বাইরে আসতে পারছে না ঢাবির বর্তমান প্রশাসন। রোকেয়া হলে কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ, ডাকসুকে একপক্ষের হাতে সমর্পণ, বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের নামে মামলা দায়ের, সাত কলেজ ইস্যু, গণরুম-গেস্টদ্বরুম সংকট, ডাকসু ভিসির উপর অব্যহত হামলা, শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনতি, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন ও মাদক রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার মতো ইস্যুগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনকে বেশ সমালোচনায় ফেলেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোটা দেশের মানুষ আস্থার স্থল মনে করে। অতীতে এই বিদ্যাপীঠ তার স্বাক্ষর রেখেছে। বর্তমানে অতি রাজনীতি, দল পূজা ও দলীয়করণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আদর্শ ও পথ থেকে ক্রমেই সরিয়ে ফেলছে। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। ক্যাম্পাসে সব শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে সমান সুযোগ দেয়া দরকার। শিক্ষার মানোন্নয়নে বিশেষ পরিকল্কপ্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পথ সুগম করার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা এখন সময়ে দাবি। এক্ষেত্রে সরকারকে উদারনীতি গ্রহণ করা দরকার। দল-মত চিন্তা না করে যোগ্য ব্যক্তিদের ভিসিসহ অন্যান্য প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেয়া গেলে বিদ্যামান অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।

লেখক: সাংবাদিক