প্রথম আলোর চরে গ্রীন ভয়েস

যেদিকে তাকাই সেদিকে শুধু দূষণ আর দূষণ। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর অপরিকল্পিত শিল্প-কারখানা নির্মাণের ফলে ক্রমান্বয়ে দূষিত হচ্ছে আমাদের চারপাশের পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে বেঁচে থাকার আবাসস্থল। বাড়ছে উষ্ণতা, ঘটছে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি। হুমকির মুখে পড়ছে জীববৈচিত্র। তবুও নেই সচেতনতা, হেয়ালিপনা আর অজ্ঞতায় নিজেরাই নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছি ধ্বংসের মুখে ।

পরিবেশ রক্ষা ও জনসচেতনা বাড়াতে পরিবেশপ্রেমী বন্ধু আলমগীর কবির ২০০৫ সালে ‘যুবরাই লড়বে সবুজ পৃথিবী গড়বে’ শ্লোগানে প্রতিষ্ঠা করেন পরিবেশ বাদী যুব সংগঠণ ‘গ্রীন ভয়েস’। এরপর গুটিগুটি পা পা করে সংগঠনটি আজ সারাদেশ জুড়ে বিস্তৃত। জেলা,স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে হয়েছে অসংখ্য কমিটি।

পরিবেশ রক্ষায় উৎসাহী, পরিবেশ সচেতন তরুণ সমাজ গড়তে, টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ-বান্ধব দেশ বিনির্মাণে পরিবেশ দূষণ, ভূমিদস্যু,জলদস্যু, বৃক্ষনিধনকারী,মাঠ বিপর্যস্তকারী, নদী-নালা-খাল-বিল দখলকারী, খাদ্যে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় গড়ে তুলেছে সামাজিক আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সারাদেশের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলা।

দিনাজপুর জেলা থেকে আমাদের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে ডাকা হলো। এমন মহৎকাজে কে না থাকতে চায়। তাই আমাকে বলা মাত্র আমি রাজি হয়ে গেলাম। সাথে আরও কয়েকজনকে প্রস্তুত করলাম যাওয়ায় জন্য। সবকিছু প্রস্তুত হলেও গিয়ে বিপত্তি বাজলো অন্য জায়গায়। যেদিনে যাওয়ার কথা সেদিনে আমার আবার শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা পড়ে গেছে। টেনশন ধরে গেলো কিভাবে কি করি! মন দুদিকে সমানে সমান। যাইহোক সাতপাঁচ ভেবে বাকীদের বললাম তোমরা যাও, আমি পরীক্ষা শেষ করে যাবো। রুবেল ও নাজমুল দুজন চলে গেলেও আমিসহ আরও তিনজন রয়ে গেলাম। ওই তিনজন আমাকে ছাড়া যাবে না। নাছোড়বান্দা তারা আমার সাথে যাবেই। সারাদিন আমার জন্য তাদের অপেক্ষা কখন আমার পরীক্ষা শেষ হবে আর কখন আমরা যাবো। বিকাল ৪টার দিকে আমার পরীক্ষা শেষ হলো এরপর এলো সেই আনন্দঘন মূহুর্ত।

দিনাজপুর থেকে রাত্রে ৯টার দিকে কুড়িগ্রামে পৌছাই আমরা। এরমধ্যে কয়েকবার ফোন দিয়ে খোজ-খবর নেন আলমগীর কবির ভাই। নামামাত্রই আমাদের দেখে এগিয়ে আসেন স্বাগত জানাতে। এরপর আমাদের নিয়ে যান প্রচ্ছদের ভাওয়াইয়া গানের আসরে। কুড়িগ্রামের সংস্কৃতির অন্যতম ধারক প্রচ্ছদ এর আয়োজনে সন্ধ্যা-৭টা ৩০ মিনিট থেকে শুরু হয় ভাওয়াইয়া পরিবেশন করেন ভাওয়াইয়া শিল্পী জীবন চন্দ্র পাল, মাহবুবা আক্তার দয়া, নাজমুল হুদা, শংকর রায় সহ স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ। এছারাও সেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা বেসুরা কন্ঠে গাইছিলো গান, অন্যরাও সাথে দিচ্ছিলো ঐক্যতান । এ যেন বহু দেহে এক প্রাণ।

হুই হুল্লোড় আর আড্ডাবাজি শেষে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন যেভাবে কাজের পরিকল্পনা সাজানো ছিলো তা অনেকটা বৃষ্টির জন্য ভেস্তে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্ত তরুণেরা কি আর হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র। বৃষ্টিতেই নাস্তা পানি করে কুড়িগ্রাম সদর শহীদ মিনার সংলগ্ন রাস্তার পাশে ব্যানার হাতে মানববন্ধনের জন্য দাঁড়িয়ে গেলো সবাই। ব্যানারে লিখা ব্রহ্মপুত্র,দুধকুমার নদী ভাঙ্গনরোধ ও কুড়িগ্রামকে বন্যার করাল গ্রাস থেকে রক্ষার দাবিতে মানবন্ধন। মানবন্ধন শেষে বৃষ্টি কিছুটা কমে গেছে। এবার উদ্দ্যেশ্য প্রথম আলোর চর দেখতে যাওয়া । সবাই অটোতে চেপে বসলো এরপর যে যার ইচ্ছেমতো গলা ছেড়ে গান গাইতে গাইতে চলতে লাগলো । আকাবাকা দুর্বোধ্য রাস্তা পেরিয়ে মিনিট ত্রিশ পরে পৌছালাম দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদীর সংযোগ নদীতে । নদী পেরিয়েই পেয়ে গেলাম সেই কাঙ্খিত প্রথম আলোর চর । তখন দুপুর ২ টা বাজে প্রায় । চরে পৌছেই ফটোসেশন ,ফুটবল নিয়ে যে যার মতো ছুটাছুটি শুরু করলো । আমার হাতেও ক্যামেরা ছিল আমি এদিক সেদিক ছবি উঠাতে থাকলাম । পেটে ক্ষিধে ছো ছো করতে লাগলো । এর প্রায় ঘন্টা খানেক পরে কুড়িগ্রাম জেলার প্রথম আলোর প্রতিনিধি সফি খান আংকেল এর নেতৃত্বে প্রথম আলো পাঠশালার দিকে হাটা শুরু করি । প্রায় ৩০ মিনিট হাটার পরে পৌছে যাই প্রথম আলোর চর পাঠলশালায় । সেখানে আগে থেকে খাবার প্রস্তুত করা ছিলো । সবাই ফ্রেশ হয়ে খেতে গেলো । আমি খাচ্ছি আর চিন্তা করছি এর নাম প্রথম আলোর চর হলো কেন ? তাহলে কি অন্যান্য জাতীয় পত্রিকা গুলোরও কি এভাবে নাম দেয়া আছে । যাই হোক, আগ্রহ থেকে খাওয়া শেষে প্রথম আলোর চর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য শহীদুল ইসলামের সাথে নামকরন বৃত্তান্ত নিয়ে কথা হয় ।

কুড়িগ্রাম শহর থেকে দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে ২৫ বছর আগে জেগে ওঠে এই চরটি। দৈর্ঘ্যে ২ কিলোমিটার, প্রস্থে ১ কিলোমিটার। । পাশেই ভারতের আসাম। চরের ভেতরে গিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায়। সাদা ফুলের মধ্যে সবুজের ছড়াছড়ি। টিনের চালার ওপর লাউ, চালকুমড়া, শিম। বাড়ির পাশেই নানা শাকসবজির খেত। এসবই প্রথম আলোর চরের এখনকার চিত্র।

জানা যায় , ৬০০ একর জুড়ে এই জায়গাটি প্রথম দিকে ছিল ধু ধু বালুচর। পাশ্ববর্তী ইউনিয়ন ঘোগাদহ, যাত্রাপুর এবং নুনখাওয়া ইইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেম্বার থাকলেও তারা কেউই সেভাবে নিজেদের পরিচয় দিতো না এবং কোন খোঁজখবরও নিতো না ঐ এলাকার মানুষজনের । প্রথম আলোর প্রতিনিধি সফি খান প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুদের নিয়ে একদিন সেই দুর্গম এলাকায় যান এবং সেখানকার মানুষের খোজ-খবর নেন । সফি সাহেব প্রায়ই সেখানে যাওয়া-আসা শুরু করতে থাকেন। এরপর ২০০২ সালে বন্যায় বরুয়া, রলাকাটা, কালীর আলগা, ঝুনকার চরে মানুষের বসতভিটা ভেঙে গেলে এ চরে কাশিয়া কেটে বাড়ি তৈরি করে কিছু মানুষ। প্রথম বসতি স্থাপন করেন শিক্ষক মোক্তার আহাম্মেদসহ ১৬টি পরিবার। তাদের দেখ ভালোর জন্য সফি সাহেব এদেরকে ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য লোকমান রহমানের সাথে জুড়ে দেন। ঘোগাদহ ইউনিয়নের সাথে জুড়ে দেয়া হলেও সেই চরের কোন নাম ছিলো না ।

২০০৪ সালের ১৫ নভেম্বর ঈদুল আজহার দিন বন্ধুসভার উদ্যোগে চরে গরু কোরবানি দেওয়ার সময় শিক্ষক মোক্তার আহাম্মেদের বাড়ির সামনে চরবাসী হাজির। মোক্তার আহাম্মেদের ছেলে জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এতো বড় বিস্তৃর্ণ এলাকায় আমরা বাস করি, কিন্তু কোন নাম নেই। এই চরের একটা নাম থাকা দরকার । এতোদিন থেকে প্রথম আলো বন্ধুসভার ছেলেমেয়েরা আমাদের সুখে–দুঃখে সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাই আজ থেকে এই চরের নাম দিলাম প্রথম আলোর চর। তখন সমস্বরে সবাই চিৎকার করে ওঠে ‘প্রথম আলোর চর, প্রথম আলোর চর’। সেই থেকে নাম হয় প্রথম আলোর চর ।প্রতিবছর বিভিন্ন চরে ভাঙন শুরু হলে অসহায় পরিবারগুলো এই চরে এসে বসতি গড়ে তোলে । এভাবে এখন প্রায় সাড়ে ৩০০ পরিবারের প্রায় ১ হাজার ৮০০ মানুষ বসবাস করছে সেখানে।

প্রথম আলোর উদ্যোগে সেখানে প্রথম আলোর চর পাঠশালা নামে একটি স্কুলও নির্মিত হয়েছে । সেটিও অষ্টম শ্রেনী পর্যন্তই সিমাবদ্ধ। গ্রামের যারা একটু উচ্চ শিক্ষিত তারাই এই স্কুলটি পরিচালনা করছেন ।বর্তমানে স্কুলটিতে দুই শ’র অধিক শিক্ষার্থী এবং ৫ জন শিক্ষক ও একজন আয়া রয়েছে । প্রতিবছরেই শিক্ষার্থীরা খুব ভালো রেজাল্ট করছে ,পাসের হার প্রায় ৮০ ভাগ । তাদের অনেকেই এখন দেশের নামি-দাবি কলেজে পড়াশোনা করছেন।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর ।