আজ পবিত্র আশুরা: অপশক্তির কাছে মাথা নত না করার দিন

নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া/ আম্মা গো লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া/ কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/ সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারের ছোরাতে... আজ ১০ মহররম। পবিত্র আশুরা। ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী ঘটনার দিন। বিশ্ব ইতিহাসেও দিনটি স্বীকৃত নির্মমতার জন্য।

ইতিহাস ছাপিয়ে কারবালার মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনা এ দিবসকে আত্মোৎসর্গ আর ন্যায়নীতির সত্য-সুন্দর প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চেতনায় সমুজ্জ্বল করে রেখেছে। সে সঙ্গে অন্যায়-অনাচার-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে দিবসটি। মুসলিম জাতির কাছে নানাবিধ কারণে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এ দিবস। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) ওফাতের বহু বছর পর ফোরাত নদীর তীরে তারই প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র এবং হজরত আলী (রা.) ও মা ফাতেমার (রা.) দ্বিতীয় পুত্র হজরত ইমাম হোসেনের (রা.) শাহাদাৎবরণের ঘটনা এ দিবসকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, নতুন মর্যাদা। সৃষ্টি করেছে অনন্য ইতিহাস।

৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের মোতাবেক ৬১ হিজরীর এই সেই দিবস যেদিন অপশক্তি-অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথানত না করে সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের পথে লড়াই করে বীরের মতো পরিবারের অনেক সদস্য ও সহচরকে নিয়ে শাহাদাৎবরণ করেন হজরত ইমাম হোসেন (রা.)। সেই দুঃখময় স্মৃতি আজো বিশ্ব মুসলিমকে কাঁদায়। সে সঙ্গে প্রেরণা জোগায় ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্যায়-অনাচার অসত্য-অসুন্দরের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম করার। কবির ভাষায় 'ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না'।

আশুরার নামকরণ নিয়ে ওলামাগণের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। অধিকাংশের মতে, মহররম মাসের দশম তারিখ বিধায় এ নামকরণ। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় দশমী। কারও মতে, এ তারিখে মহান রাব্বুল আলামিন দশজন পয়গম্বরকে তার অনুগ্রহের দ্বারা ধন্য করেছেন বলেই এ নামকরণ। এদিন হজরত আদমের (আ.) তওবা কবুল হয়, মহাপস্নাবনের পর নূহনবীর কিশতি সর্বপ্রথম মাটির সংস্পর্শ লাভ করে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) ভূমিষ্ঠ হন, হজরত দাউদ নবীর তওবা কবুল হয়, হজরত আইয়ুব নবীর রোগ-যাতনা উপশম হয়, মুসা নবীকে আলস্নাহ উদ্ধার করেন, ইউনুছ নবীকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দান করেন, ঈশা নবীকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়। মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ফরজ হিসেবে রাখা হতো। অতঃপর যখন রমজান মাসের রোজার হুকুম অবতীর্ণ হলো তখন তা নফলরূপে গণ্য হয়। রাসুলে করিম (সা.) আরও এরশাদ করেন, রমজান মাসের ফরজ রোজার পর মহররম মাসের রোজা সর্বোত্তম (মসলিম)। তিনি আরও এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিন নিজ পরিবার-পরিজনের জন্য মুক্ত হাতে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে সারা বছর সচ্ছলতা দান করবেন।

যথাযথ মর্যাদায় ধর্মীয় পরিবেশে আজ পালিত হবে পবিত্র আশুরা। নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে বের হবে বর্ণাঢ্য তাজিয়া। ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ পবিত্র কোরআনখানি, ওয়াজ-মিলাদ মাহফিল, জিকির আজকার, আলোচনা সভা, নফল নামাজ, মাজার-কবর জিয়ারত, দান-খয়রাত প্রভৃতির মাধ্যমে পবিত্র দিবসটি অতিবাহিত করবেন। অনেকে রোজা রাখবেন। দিবসটি পালনে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

পবিত্র আশুরা উপলক্ষে আয়োজিত তাজিয়া মিছিলের জন্য নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে মিছিল শুরুর পর মাঝপথে অলিগলি থেকে কাউকে মিছিলে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না।

ডিএমপি কমিশনার জানান, আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিলকে কেন্দ্র করে রাজধানীর হোসেনি দালান, ইমামবাড়া, মিরপুর, বড় কাটারা, ছোট কাটারা ও মোহাম্মদপুর এলাকায় মহররমের ৬ থেকে ৯ তারিখ পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রাজধানীর প্রতিটি ইমামবাড়া সিসিটিভি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যারা শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন, তাদের প্রত্যেককে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টরে তলস্নাশি হয়ে আসতে হবে। মিছিলে সব ধরনের ধাতব বস্তু, ছোরা-তরবারি, বর্ষা বা আগুনের কোনো বস্তু আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। নিশান ১২ ফুটের বেশি উচ্চতা হবে না।

আশুরার ইতিহাস

এই দিনে হজরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং হজরত আলী (রা.) এর পরিবারের সতের জন শিশু-কিশোর যুবকসহ মোট ৭৭ জন মর্দে মুজাহিদ কারবালার প্রান্তরে ফোয়াতের দুকূল ছাপা নদীর কিনারায় এক বিন্দু পানি হতে বঞ্চিত হয়ে শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিলেন। রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) -এর পবিত্র মস্তক নিষ্ঠুর নরাধম শিমার ছিন্ন করে কুফার দুরাচার ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের দরবারে প্রেরণ করেছিল। কেন এ মহান ত্যাগ ও শাহাদাত? এটা কি ছিল এজিদের হাত থেকে খেলাফত কেড়ে নেয়ার জন্য? তা নয়। হজরত হুসাইন (রা.) এর শিবিরে মাত্র ৪০ জন লোক ছিল তরবারি চালানোর মতো। পক্ষান্তরে এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর চার হাজার রণনিপুণ সৈন্য পাঠিয়েছিল। এ অসম যুদ্ধে পরাজয় ও মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। তারপরও কেন স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগ? কারণ, শর্ত ছিল, 'হয় এজিদের আনুগত্য স্বীকার করো, না হয় যুদ্ধ কর'। রাসুল (স.)-এর কলিজার টুকরাসম হুসাইন (রা.) একটি মুহূর্তের জন্য এজিদের আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামী খেলাফতের মর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করতে চাননি। পূর্বে উম্মাহর মধ্যে শান্তি-শৃংখলা স্থাপনের জন্য একটি লিখিত চুক্তি হয়। সেখানে বলা হয়, হজরত মুয়াবিয়ার পর হজরত হুসাইন (রা.) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। কিন্তু মুয়াবিয়া তার খেলাফত পরিচালনার শেষ সময়ে স্বীয় পুত্র এজিদকে খেলাফতের দায়িত্ব অর্পণের প্রস্তাব দেন।

এজিদ জনমতের কোনো তোয়াক্কা না করে নিজেই খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হয়। তখন সর্বত্র বিশৃংখলা দেখা দেয়। ইসলামী খেলাফতের মর্যাদাকে ধ্বংস করে রাজতন্ত্রের সূত্রপাতকে বেশিরভাগ মুসলমান সে সময় মানতে পারেননি। যার কারণে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করে এজিদের বিরুদ্ধে। এজিদ তখন ভাবল, চারদিকে বিদ্রোহ দমন করার চেয়ে বরং হুসাইনকে (রা.) যদি দুনিয়া হতে সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে সব মামলা চুকে যায়। সাথে সাথে নিজের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব অনায়াসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ইসলামী খেলাফতে কলঙ্ক সৃষ্টিকারী এজিদ সেই হুসাইনকে (রা.) হত্যা করার পরিকল্পনা করল যিনি বেহেশতের সব যুবকদের সরদার হবেন।

হুসাইনকে হত্যা করতে এজিদের নির্দেশে কুফার গভর্নর ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের সৈন্যরা সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করল। সেদিন ছিল ১০ মহররম ৬১ হিজরি ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ অক্টোবর। সকালে লাল সূর্যের উদয় হলো পশ্চিম আকাশে। ফজরের নামাজের পরই হজরত হুসাইন (রা.) তার সাথীদের দাঁড় করালেন। মাত্র ৩২ জন ঘোড় সওয়ার ও ৪০ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে গঠিত তার ক্ষুদ্র বাহিনী। ডানদিকে যুহাইর বিন কাইন এবং বামদিকে হাবিব বিন মুযাইর নিজ নিজ দলের অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন। বাহিনীকে এভাবে সাজালেন যে পেছনে তাঁবুগুলো। আর পেছনের দিকটাকে অধিকতর নিরাপদ করার জন্য পরীখাসদৃশ গভীর গর্তগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। যাতে শত্রম্নরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে। আর ফোরাতের পানির দখল নিজেদের জন্য নিয়ে নিলেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভে হজরত হুসাইন (রা.) একটি মর্মস্পর্শী ভাষণ দিলেন, হে জনমন্ডলী! তাড়াহুড়ো করো না। আগে আমার কয়েকটি কথা শোন। আমার কথা যদি তোমরা মেনে নাও এবং আমার প্রতি যদি সুবিচার করো, তাহলে তোমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মানুষ বলে পরিগণিত হবে। তোমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে আমার সাথে যে আচরণ করতে চাও তা করে নাও। আলস্নাহই আমার একমাত্র সহায়। তিনিই তার সৎ বান্দাদের সাহায্য করে থাকেন। হজরত হুসাইনের এই কথা শুনে তার শিবিরে কান্নার রোল পড়ে গেল। তখন হুসাইন (রা.) হয়তো মনে মনে বলছিলেন, এখনো তো কান্নার অনেক বাকি। যথারীতি যুদ্ধ শুরু হলো। প্রবল বীরবিক্রমে মুসলিম সৈনিকেরা শাহাদাতের পেয়ালা হাতে নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রায় দুই হাজার শত্রম্ন সৈন্যকে খতম করে দিলেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনী হতেও ঝরে পড়ল অনেকগুলো তরতাজা প্রাণ। ওবায়দুলস্নাহ বিন জিয়াদের বা এজিদের বাহিনী পানির দখল নিয়ে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুসাইন শিবিরে পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেল। কাসেমকে কোলে নিয়ে শত্রম্নদের কাছে এক কাতরা পানি প্রার্থনা করলেন। কিন্তু শিশুপুত্র আলী আকবর ও কাসেমের মৃত্যু হজরত হুসাইনকে আবারও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করল। তিনি অনেক শত্রম্ন নিধন করলেন। অবশেষে একটি তীর এসে তার শরীরে বিদ্ধ হলো। সাথে সাথে ঘোড়ার পৃষ্ঠ হতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এক টানে তীরটি বের করে ফেললেন ও শক্রদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকলেন। কিন্তু গন্ডদেশ হতে রক্তক্ষরণ তাকে দুর্বল করে ফেলল। এ অবস্থায় পরপর কয়েকটি তীরবিদ্ধ হলেন হুসাইন (রা.)। অবশেষে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কাফেররা তার মস্তক কাটার জন্য ইতস্তত করতেছিল। কিন্তু নিষ্ঠুর পাষন্ড নরখাদক সীমার হজরত হুসাইন (রা.) এর মস্তক কর্তন করে খন্ডিত মস্তক নিয়ে এজিদের দরবারে পৌঁছাল। এই যুদ্ধে হজরত হুসাইন (রা.)-এর পুত্র জয়নাল আবেদীন ছাড়া সবাই শাহাদাতবরণ করেন।