বাঙালির অহংকার ঠাঁই দাঁড়িয়ে, নির্মাতা ছিলেন অবহেলিত!

মো. আবু রায়হান ও  সৈয়দ মাইনুল হোসেন
মো. আবু রায়হান ও সৈয়দ মাইনুল হোসেন

বাঙালি স্বাভাবিকভাবে আবেগ প্রবণ এবং খানিকটা ইতিহাস বিস্মৃত অকৃতজ্ঞ জাতি বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না। যে কারণে বাঙালি জাতি ইতিহাস নিয়ে এখনো বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিধান্বিত ও প্রকৃত ইতিহাস চর্চায় অপরিপক্বতার ছাপ রাখছে। যে জাতির সূর্য সন্তানরা এনে দিয়েছে আকাশচুম্বী সম্মান ও গৌরব, তাদেরকেই কখনো কখনো আমরা করেছি অপদস্থ ও তিরস্কার।

তাঁরা অনেকে পাননি মেধার ও কাজের নূন্যতম স্বীকৃতি। ফলে জীবন সায়াহ্নে জাতির এসব মেধাবী সন্তানেরা অভিমানে বেছে নিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে নীরব নিভৃত জীবন। হয়তো অভিমান আর কষ্টে তাদের এমনি ভাবে নীরব প্রস্থান।

ঠিক এমনি একজন হলেন জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের অমর কীর্তি জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি তথা রূপকার সৈয়দ মাইনুল হোসেন। এই বাঙালি কীর্তিমান পুরুষ বাংলাদেশের প্রখ্যাত এ স্থপতি জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও আরো বিখ্যাত স্থাপনার একজন সুদক্ষ স্থপতি হিসেবে অমর হয়ে আছেন।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরবর্তীতে ডিজাইন আহ্বান করা হয়। এতে প্রায় ১৭-১৮ জন প্রতিযোগীর ৫৭টি নকশার মধ্যে ২৬ বছর বয়সী তরুণ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনের প্রণীত নকশা গৃহীত হয়েছিল।

স্থপতি মাইনুল হোসেনের স্মৃতিসৌধের নকশা অনুসারেই তিন পর্যায়ে মোট ১৩.০০ কোটি টাকা ব্যয়ে, ৪৫.৭২ মিটার উঁচু, সাতটি ফলকে ঢাকা থেকে ৩৫ কিমি দূরত্বে সাভারে নির্মিত হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধের সাতটি ফলক বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরে। সাতটি ফলকে বাঙালির অধিকার আদায়ের ধারাবাহিক আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলনের পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়কে নির্দেশ করে।

১৯৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬২ শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ- এই সাতটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ পরিক্রমা হিসাবে বিবেচনা করে সৈয়দ মাইনুল হোসেন সৌধটি নির্মাণ করেন।

জাতির জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ মহৎ কাজ যিনি আঞ্জাম দিলেন সেই মহৎ মানুষটি জীবদ্দশায় ছিলেন চরমভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। মৃত্যুর আগে তার সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠে সেই ভয়ানক অমানবিক চিত্র। যা তাঁর সঙ্গে করা হয়েছিল।

জাতীয় স্মৃতি সৌধের নির্মাণ কাজ শেষ হলে ১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ. এম এরশাদ জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এর স্থপতি তথা কারিগর সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অতীব কষ্টের বিষয় যার হাত ধরে এ সুউচ্চ সৌধ নির্মিত তিনি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ চলে যাওয়ার পর সেখানে গিয়ে সাধারণ জনতার সারিতে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তাঁর অমর কীর্তি। সেদিন হয়তো স্মৃতিসৌধের স্থপতি মনে মনে উচ্চারণ করেছিলেন রবি ঠাকুরের অমর সৃষ্টি সোনার তরী কবিতার পঙক্তিমালা,

‘এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি-
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।’

জ্ঞান তাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় বলতেন ‘যে দেশে গুনীর কদর নেই, সে দেশে গুনী জন্মাতে পারেনা।’

আমরা বাঙালি বড়ই অকৃতজ্ঞ জাতি। মানি মানুষের প্রতি সম্মান দেখাতে পারি না। তাদের অবদান তুচ্ছ জ্ঞান করি, তাঁদের খাটো করি, তাদের অবদান অবলীলায় ভুলে যাই। যে মানুষটি বেঁচে থাকতে দুবেলা দুমুঠো খেতে পারে না তাকে মৃত্যুর পর দেখানো হয় হৃদয় উৎসর্গীকৃত ভালোবাসা, দেওয়া হয় মরণোত্তর পুরস্কার।

এ মহৎ মানুষটির বেঁচে থাকতে কি আক্ষেপের শেষ ছিল? পত্রিকায় ইচ্ছা করেই তার নাম বিকৃত ভুল বানানে লেখা হয়েছিল। এখনো অনেক বইয়ে সেই ভুল বানান চলছে। তিনি বোধহয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে ভুলই করেছিলেন তা না হলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পর তাঁকে বেনামি পত্র দিয়ে কারা তাঁকে খুন করতে চেয়েছিল? এটাও তার অনুযোগ ছিল।

রাষ্ট্র কি পেরেছিল তাঁকে সুরক্ষার আশ্বাস দিতে? পাশে কি দাঁড়িয়েছিল? বড়ই আশ্চর্যজনক ঘটনা কি জানেন? ডিজাইনের সম্মানী বাবদ ২ লাখ টাকা তাঁকে দেবার কথা ছিল। তাঁর এ টাকার আয়কর ধরা হয়েছিল ৫০ ভাগ। তার মানে ২ লাখ টাকায় আয়কর ১ লাখ টাকা। উনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রাজস্ব বোর্ডের কমিশনারকে ম্যানেজ করে শেষমেশ ২০ হাজার টাকা আয়কর তিনি দিয়েছিলেন।

এতো বড় মাপের একজন মানুষ। এতো বড় যার কৃতি। বেঁচে থাকতে তাঁর চিকিৎসা তো দূরে থাক, সামান্য খোঁজটাও নেয়নি এ রাষ্ট্র। আমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ হতভাগা জাতি! এ মানুষটি পাওয়া না পাওয়ার কথা না ভেবে অনেকটা নির্জন বাসের পর অভিমানেই চলে গেছেন ২০১৪ সালে তাঁর অক্ষয় কৃতি রেখে। ক্ষমা করো এ মহৎ আত্মা অকৃতজ্ঞ এ জাতিকে। তোমার ঝুলিতে একুশে পদক ছাড়া স্বাধীনতা পদকও জমা হয়নি না। আফসোস তোমার অনুজদের কৃতকর্মে।