একটি দুর্ঘটনা, একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ!

ক্র্যাচে ভরদিয়ে দাঁড়িয়ে রাকিবুল

পড়তেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা-মার স্বপ্ন ছিল ছেলে রাকিবুল লেখা-পড়া শেষ করে প্রশাসন ক্যাডার হবে। ছেলেরও সেই ইচ্ছাই ছিল। দিনের পর দিন সেই স্বপ্নকে ধারণ করেই ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন ঢাকায় “বাংলাদেশ ইউনির্ভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয়ের” বিবিএ প্রোগ্রামে। কিন্তু হঠাৎ করে সেই স্বপ্নকে চুরমার করে দিল এক মূহুর্তের একটি সড়ক দুর্ঘটনা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত প্রায় এক বছর ধরে সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ক্ষত “পঙ্গুত্বের” যন্ত্রণা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন এই মেধাবী ছাত্র ও তার পরিবার। ছেলের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে পরিবারটি আজ নি:স্ব হয়ে অর্থেকষ্টে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, ক্ষতিপূরণ হিসেবে আজ পর্যন্ত এক টাকাও পাননি রাকিবুল ও তার পরিবার।

রাকিবুলের বাবা ফরিদ খান জানান, রাকিবুল এসআর ট্রাভেলসের যাত্রীবাহী বাসে গত বছরের ১লা সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় হিলি থেকে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরছিল। রাত দেড়টার দিকে এসআর ট্রাভেলসের নেশাগ্রস্ত চালক বগুড়ার শেরপুরের ধুনট মোড়ে দাঁড়ানো একটি পাথর বোঝাই ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এসময় যাত্রীবাহী কোচের সুপারভাইজার জাহিদুল ইসলাম নিহত হয়। ওই বাসের যাত্রী আমার ছেলে মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং তার বাম পায়ের পাঁচটি স্থানে ভেঙ্গে যায়। আমি খবর পেয়ে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে যায়। সেখানে ছেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে পরবর্তীতে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করি।

তিনি আরও জানান, পঙ্গু হাসপাতালে গত ১০ মাস ধরে এ পর্যন্ত তার পায়ে চারটি অপারেশন করা হয়েছে। আরও দুই-একটি অপারেশন করা হতে পারে বলে চিকিৎসক জানিয়েছে। ইতোমধ্যেই ছেলের চিকিৎসা বাবদ দশ লক্ষ টাকার উপরে ব্যয় হয়েছে। আরও কয়েক লক্ষ টাকা চিকিৎসা করাতে লাগবে। এঘটনায় আমি ক্ষতিপূরণের জন্য এসআর ট্রাভেলসের দায়িত্বে থাকা বগুড়ার প্যারিস নামে একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু তিনি আমাকে আজ-কাল করে সময় ক্ষেপন করেছেন। যাতে আমি ক্ষতিপূরণের জন্য আইনগত কোনো দিকে না যায়। পরে এসআর ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম রহমান শহীদের মোবাইল নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে। পরে ওই এমডির সাথে যোগাযোগ করেও কোনো আশ্বাস পাইনি।

গত বুধবার দুপুরে (২১ আগস্ট) প্যারিস নামে ওই ব্যক্তির সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, গত ৩/৪ মাস আগে আহত ব্যক্তির বাবা একটি মাধ্যমে আমার কাছে আসেন। আমি তখন এসআর ট্রাভেলসের এমডির সাথে যোগাযোগ করতে বলি। এরপর আর কিছু জানি না। প্যারিস দাবী করেন তিনি এসআর ট্রাভেলসের কেউ না।

রাকিবুলের মা আনজু আরা খান বলেন, ছেলেকে নিয়ে আমাদের পরিবারে অনেক স্বপ্ন ছিল, একটি দূর্ঘটনা আমাদের সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। নেশাগ্রস্ত চালকের কারণেই আমার লেখা-পড়া করা ছেলেটি আজ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। ছেলের দিকে তাকাতে পারি না। সব সময় ফুফড়ে ফুফড়ে কান্না করি। ছেলের চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে আমরা নি:স্ব হয়ে গেছি। তবে ছেলের নতুন জীবন পেয়েছি-এটাই আল্লাহর কাছে লাখো-কোটি শুকরিয়া।

এদিতে গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে বাড়িতে দেখতে গেলে ক্র্যাচে ভরদিয়ে কাছে আসেন রাকিবুল। এসময় তিনি কান্নাকন্ঠে বলেন, লেখা-পড়া আর আমার ভাগ্যে নাই। সারাজীবন পঙ্গুত্বকে বরণ করেই চলতে হবে। যে আশা, যে উদ্দেশ্য নিয়ে শিক্ষা-জীবন শুরু করেছিলাম এখন দেখছি সেটা শুধুই স্বপ্ন।

এদিকে এঘটনায় গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শেরপুর পুলিশ ফাঁড়ীর উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবু তাহের বাদী হয়ে শেরপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলা নং ৪। মামলায় তিনি (বাদী) উল্লেখ করেন ১লা সেপ্টেম্বর রাত দেড়টার দিকে এসআর ট্র্যাভেলস নামে কোচটি বগুড়ার ধুনট মোড়ে দাঁড়ানো পাথর বোঝাই ট্রাককে ধাক্কা দিলে কোচের সুপারভাইজার জাহিদুল ইসলাম নিহত ও হেলপার সহ ৪/৫ জন জখম হয়। পরে এসআর ট্র্যাভেলের চালক ও পাথর বোঝাই ট্রাকের চালকের (অজ্ঞাত) নামে মামলা করা হয়। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরপুর টাউন পুলিশ ফাঁড়ীর পরিদর্শক জিল্লুর রহমান গত ৭ ফেব্রুয়ারি বগুড়া আদালতে মামলার চার্জশীট দাখিল করেন।

এবিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) এসআর ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম রহমান শহীদ মুঠোফোনে বলেন, এক বছর আগের ঘটনা। খবর পেয়ে আমাদের লোকজন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিল। আমরা কিছু আর্থিক সহায়তা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা নিতে চাননি। এখন যদি তারা চিকিৎসা ব্যাপারে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাই তাহলে তো আর দেওয়া সম্ভব না। তবে আহত রাকিবুলের পরিবারের সাথে আবারও যোগাযোগ করবেন বলে জানান তিনি।