মানুষগুলোর মুখের হাসিতে এঁরা পান ঈদের আনন্দ

রাত তখন প্রায় বারোটা। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশের গেট দিয়ে প্রবেশ করছে কয়েকটি গাড়ি। এত রাতে স্টেডিয়ামে সাধারনত গাড়ি আসে না। গাড়ির পিছনে আমরাও প্রবেশ করলাম। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে দেখা গেল স্টেডিয়ামের বারান্দা ও রাস্তায় সারি সারি মানুষ শুয়ে আছে। তাদের গায়ে তেমন কোন পোশাক নেই। বেশিরভাগ মানুষ শুধুমাত্র একটি পত্রিকা বিছিয়ে ঘুমিয়ে আছে। সংখ্যাটা কম করে হলেও ২৫০ থেকে ৩০০ হবে। এদের কি ঘর বাড়ি নেই? এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল, না এদের কোন ঘর বাড়ি নেই।

এরপর শুরু হলো এসব মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ। সবাই আড়মোড়া ভেঙে খাবার পেয়ে যুদ্ধ জয়ের হাসি মুখে। কেউবা খাবার পেয়েই খাওয়া শুরু করছেন। কি আছে খাবার? কার্যক্রমের উদ্যোক্তা বাংলাদেশ পুলিশের বৃহৎ ফেসবুক গ্রুপ ‘বিপি হেল্পলাইন’র এডমিন এসআই হাফিজুর রহমান জানালেন প্রত্যেকের জন্য বিরিয়ানীর প্যাকেট ও কোল্ড ড্রিঙ্কস বরাদ্দ আছে।

খাবার পাওয়া গৃহহীন মানুষদের অনুভূতি সকলের প্রায় একই রকম। ‘আমাদের কোন ঘর বাড়ি নেই। আমাদের যদি ঘর বাড়িই থাকতো তাহলে এ কুরবানীর দিন রাতে কেউ এখানে পড়ে থাকতাম না। যাদের একটু কুড়েঘরও আছে তারা বাড়ি চলে গেছে। আমাদের চাল নেই চুলা নেই, তাই যাওয়ার জায়গাও নেই। ঈদের দিন কোন হোটেল খোলা থাকে না। ইচ্ছে বা সামর্থ থাকলেও সারাদিন কিছু খেতে পাই না। আল্লাহ আমাদের কষ্টের কথা ভেবে এ মানুষগুলোকে খাবার দিয়ে পাঠিয়েছেন। ওনারা না এলে সারাদিন ও রাত না খেয়েই থাকতে হতো।’

পাঁচদিন আগে ভুমিষ্ট হওয়া এক কন্যা সন্তানের মায়ের মুখে অশ্রুসজল হাসি দেখা গেল। তার সন্তান বুকের দুধ না পেয়ে অনেক কান্না করছে। কারণ সারাদিন কিছু খেতে পারেনি মহিলাটি। বিপি হেল্পলাইন গ্রুপের উদ্যোগে খাবার পেয়ে তিনি অবাক হয়েছেন। তার মনে হয়েছে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা তার সন্তানের কষ্ট দেখে এ মানুষগুলোকে পাঠিয়েছেন। খাবার বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ডিএমপি ওয়ারী জোনের এডিসি ইফতেখায়রুল ইসলাম জানালেন এ এক অনন্য উদ্যোগ। এ বছর নিয়ে টানা তিন বছর গৃহহীন মানুষের মাঝে এভাবে খাবার বিতরণ করছেন বাংলাদেশ পুলিশের ফেসবুক গ্রুপ বিপি হেল্পলাইন। তাদের নিকট থেকে জানতে পেরে এবারই যুক্ত হয়েছেন তিনি এ কার্যক্রমে। আগে ফেসবুকে দেখেছেন কিন্তু বাস্তবে আজ গৃহহীন মানুষদের এ অবস্থা দেখে অবাক হয়েছেন। ঈদের দিন হোটেল বন্ধ থাকায় এরা সারাদিন অনাহারে থাকে, এ বিষয়টি তাঁকে ব্যথিত করেছে।

গৃহহীন সবুর মিয়ার সাথে কথা বলে জানা গেল তারা সারাদিন খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ঈদের দিন কোথাও খাবারের ব্যবস্থা হয় না। বাড়িওয়ালারা কাঁচা মাংস দেয় কিন্তু সে মাংস রান্না করে খাওয়ার সামর্থ তাদের নেই। কেউ রান্না করা মাংস বা কোন খাবার দেয় না। ঈদের দিন সকলের জন্য আনন্দের হলেও তাদের জন্য নিরানন্দের। বরং অন্যদিন তারা কাজ পায়, কাজ করে টাকা উপার্জন করে হোটেল থেকে খাবার কিনে খায়। ঈদের দিনে এ সুযোগ নেই তাদের।

বাংলা ব্লগের জনপ্রিয় ব্লগার দাদুভাই (মোহাম্মদ সামছুদ্দিন) জানালেন তিনি গতবছরও এ প্রোগ্রামে ছিলেন। এ বছর নিজেই খোঁজ নিয়ে এসেছেন। কুরবানীর দিন এমন মানুষদের পাশে থাকতে পেরে তিনি গর্বিত। বিপি হেল্পলাইন ফেসবুক গ্রুপের এ কার্যক্রমকে তিনি অনন্য অসাধারন বলে অভিহিত করেন।

বিপি হেল্পলাইন গ্রুপের এডমিন হাফিজুর রহমান জানান তিনি বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি অফিসে কর্মরত আছেন। এ অনুষ্ঠানের প্রথম উদ্যোগ নেন ২০১৭ সালে। বছরে দুটি ঈদেই তারা ভিন্ন ভিন্ন খাবার আয়োজন করে থাকেন। ঈদ-উল-ফিতরে প্রোগাম করেন দিনে। যারা ঈদের আনন্দ রেখে কর্তব্যের টানে রাজপথে থাকেন তাদের জন্য পায়েস, কেক, মিষ্টি, চকলেট, ক্যান্ডি, কোল্ড ড্রিঙ্কস এর প্যাকেট বিতরন করেন ঢাকা শহরের প্রায় সকল রাস্তায়।

এ তালিকায় থাকেন পুলিশ, সাংবাদিক, সিকিউরিটি গার্ড, রিক্সা, বেবিট্যাক্সি ও বাস চালক এবং রাস্তায় থাকা ভিক্ষুক ও পথশিশু। আর ঈদ-উল-আযহায় প্রোগ্রাম করেন রাতের বেলায় গৃহহীনদের জন্য। এসব গৃহহীন অভুক্ত মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন তারা। রাজধানীর জাতীয় স্টেডিয়াম, মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল‌ওয়েল মার্কেট, কমলাপুর এলাকায় ভাসমান গৃহহীন মানুষের মাঝে বিতরণ করেন এ খাবার।

এ কাজে তাঁকে গ্রুপের বিভিন্ন ব্যক্তি সহায়তা করেন। তাদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন গত তিন বছর আগে সামান্য আয়োজন নিয়ে শুরু করেছিলেন। সকলের আকুণ্ঠ সমর্থনে এবার ৫০০ জন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছেন। আর গত ঈদ-উল-ফিতরে হাসি ফুটিয়েছিলেন ৮০০ মানুষের মুখে। এ কার্যক্রমের দুই ঈদে শ্লোগান থাকে ভিন্ন। ঈদের দিন যারা থাকে রাজপথে, ঈদ আনন্দ তাদের সাথে এবং গৃহহীন যারা থাকে রাজপথে, ঈদ আনন্দ তাদের সাথে এ দুটি শ্লোগান নিয়ে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি ছুটি পেলেও ঈদে বাড়ি যান না শুধু এসব মানুষের মুখে এক চিলতে হাসি দেখতে।

আমরা ঈদের দিনকে আনন্দের দিন বলে থাকি। কিন্তু এ দিনে যারা আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে বিপি হেল্পলাইন নামক পুলিশের ফেসবুক গ্রুপের এ আয়োজন সত্যিই অসাধারন উদ্যোগ। আমরা আনন্দের মাঝে ভুলেই যাই এমনও মানুষ আছে যারা ঈদের দিনে থাকে নিরানন্দে। পুলিশের নিজ কর্তব্যের বাইরে মানবিক কাজে এমন অংশগ্রহণ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। গৃহহীন মানুষের মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেয়া এ মানুষগুলোর জন্য আমাদের নিরন্তর শুভকামনা ও ভালবাসা। (সংগৃহীত)