হুমায়ুন আজাদের কবিতা ও সাহিত্যপাঠ স্মরণে

“আজাদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একাডেমিক কোনো কোনো দিকের যেমন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা ছিলেন, তেমনি নন-একাডেমিক ক্ষেত্রেও তাঁর বিপুল পদচারণা ছিল। একদিকে যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এই সাহিত্যের নতুন অগ্রদূত, তেমনি হয়ে উঠেছিলেন সাহসী চিন্তার অভিনব অগ্রপথিক।”

হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) এমন এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রথাগত মাস্টার’হয়েও ‘প্রথাগত মাস্টার’হন নি; নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উৎরে গেছেন এই তকমাকে। একজন প্রথাগত মাস্টার হয়েও লেখালেখি ও স্বকীয় ভাবনার সূত্রে তিনি নিজের একটি স্বতন্ত্র জগত নির্মাণ করে নিয়েছিলেন। প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টাররা যেরকম দুর্বল ও বাঁকা মেরুদণ্ডের অধিকারী হন, আজাদ তেমনটা ছিলেন না। এই বিষয়টি জানা যায় তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা কর্মকাণ্ডের সুবাদে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাতে এমন শিক্ষক দু’ চারজনই পাওয়া যায়; আজাদ ছিলেন তাঁদের প্রধানতম, নানাদিক থেকে বিবেচনায়। আজাদ প্রতিভাবান ছিলেন। একাডেমিভাবে তিনি যেমন ছিলেন দুর্দান্ত; ঠিক তেমনি একাডেমির বাইরেও ছিলেন বেশ স্বপ্রতিভ; জ্ঞানচর্চার নানা দিক থেকে। বলে রাখা জরুরি, আজাদের এসব ভাবনার নানা উৎসারণ আমরা দেখতে পাই তাঁর কাজকর্মের মধ্যে। মনে রাখা দরকার, আজাদ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একাডেমিক কোনো কোনো দিকের যেমন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতা ছিলেন, তেমনি নন-একাডেমিক ক্ষেত্রেও তাঁর বিপুল পদচারণা ছিল। একদিকে যেমন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের মধ্য দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এই সাহিত্যের নতুন অগ্রদূত, তেমনি হয়ে উঠেছিলেন সাহসী চিন্তার অভিনব অগ্রপথিক।

প্রথম থেকেই আজাদ নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন। এই ব্যাপারটা ঠিক কবে কোথায় এবং কীভাবে ঘটতে শুরু করেছিল, দিন-তারিখ ধরে তা বলা কঠিন। ব্যাপারটা গভীর গবেষণার বিষয়। তবে মোটাদাগে বললে, স্বাধীনতার আগে শুরু হওয়া তাঁর লেখকজীবন স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিককাল দীর্ঘস্থায়ী ছিল। এই সময়ে তিনি সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের চর্চা করে গেছেন। প্রথম দিকে বুদ্ধদেব বসুদের মতো আধুনিকতাবাদী সাহিত্যাদর্শে নিম্মজিত থেকে সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চায় অবতীর্ণ হলেও, পরবর্তীকালে নানা পারিপার্শ্বিক চাপের মধ্য আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্ব থেকে সরে আসেন। বলে রাখা দরকার, আজাদ ষাটের দশকের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যার মূলে ছিল ভাষাআন্দোলনের বিপুল প্রভাব, তার দ্বারা আলোড়িত হয়েছিলেন।

জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চূড়ান্ত ফলাফল স্বাধীনতাযুদ্ধের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সমানভাবে ক্রিয়াশীল ছিল আজাদের মধ্যে, শেষদিন পর্যন্ত। আর তারই প্রভাবে বদলে যেতে থাকেন আজাদ। আধুনিকতাবাদী নন্দনতত্ত্বের বাইরে এসে তিনি এক ভিন্ন মানসে সাহিত্য ও ভাষাচর্চায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। এর ফলেই হয়তো-বা আজাদ হয়ে উঠেছিলেন সম্পূর্ণ নতুন একজন লেখক। চিহ্নিত হয়েছিলেন প্রগতিশীল বলে। কারণ আজাদের লেখা তখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, এটা বলছি যুদ্ধের পরের কথা। দৈনিক থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের পত্রপত্রিকায় লিখে আজাদ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করেন। তবে এটা যে বাঙালি নতুন দেখলো তা নয়, আগেও দেখেছে, কিন্তু আজাদের হঠাৎ এমন রাজসিক প্রগতিপন্থী আগমনে দেশ বেশ সচকিত হয়ে ওঠে। সেটা একদিক থেকে একটা আন্দোলনই ছিল বলা চলে, আজাদ তাঁর চিন্তা দিয়ে প্রভাবিত করেছিলেন অনেককেই; এখনো প্রভাবিত হচ্ছেন অনেকে।

১৯৬০-এর দশক। আজাদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। ঠিক এই সময়েই পশ্চিমী ভাষাবিজ্ঞানী চমস্কি-উদ্ভাবিত ‘সৃষ্টিশীল রূপান্তরমূলক ব্যাকরণ’ (Transformative Generative Grammer- TG) তত্ত্বটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য আজাদ এই তত্ত্বের কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে বাংলা ভাষার রূপান্তরমূলক তথা বাক্যতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্রপাত হয়। তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল Pronominalization in Bengali (অর্থাৎ বাংলা ভাষার সর্বনামীয়করণ)। একই শিরোনামে পরে ১৯৮৩ সালে এটি বই আকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে তিনি বাংলা বাক্যতত্ত্বের ওপর ‘বাক্যতত্ত্ব’ নামে আরেকটি বাংলা বই প্রকাশ করেন।

অল্পকাল পরে ‘বাঙলাভাষা’ শিরোনামে তাঁর দুই খণ্ডের একটি দালিলিক সংকলন প্রকাশিত হয়। এতে বাংলা ভাষার বিভিন্ন দিকের ওপর বিগত শতবর্ষ ধরে প্রকাশিত বিভিন্ন ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকের গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতাত্ত্বিক রচনা সংকলিত হয়েছিল। এই ভাষাবিজ্ঞানের পর্যালোচনা পদ্ধতিটি ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে প্রাগ্রসর আলোচনা-পদ্ধতি। এর মাধমেই তিনি বহুদিনের প্রাচীন, ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানের বাইরে গিয়ে নতুন পদ্ধতিতে বাংলা ভাষাবিজ্ঞানের চর্চা শুরু করেন। আর ‘বাঙলাভাষার শত্রুমিত্র’ গ্রন্থে রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে আজাদ বাংলা ভাষার সমসাময়িক পরিস্থিতির বয়ান নির্মাণ করেছিলেন। এ তো গেল ভাষাবিজ্ঞান চর্চার কথা। এ ক্ষেত্রেও, বলা বাহুল্য, দারুণ প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মধ্য দিয়ে এগিয়েছেন আজাদ। অর্থাৎ, ভাষার আলোচনা-সমালোচনার জন্য গ্রহণ করেছিলেন সমসাময়িক বৈশ্বিক ভাষাবিজ্ঞান চর্চার রীতিপদ্ধতি।

প্রবন্ধ সাহিত্যে আজাদ অবিসংবাদিতভাবে একজন সমাজসচেতন চিন্তক ও ভাবুক। সমসাময়িক নানা বিষয়কে তিনি তাঁর প্রবন্ধে উপজীব্য করেছেন। সহজেই যে কেউ তাঁর প্রবন্ধের ওপর চোখ বুলিয়ে গেলেই এই ব্যাপারটা ধরতে পারবেন। রবীন্দ্রপ্রবন্ধ : রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা (১৯৭৩), শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা (১৯৮৩), ভাষা-আন্দোলন : সাহিত্যিক পটভূমি (১৯৯০), প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে (১৯৯২), আমার অবিশ্বাস (১৯৯৭), পার্বত্য চট্টগ্রাম : সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা (১৯৯৭), আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম (২০০৩) প্রভৃতি প্রবন্ধ-গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি পাঠের পর দেখা যায়, নানা ধরনের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার তীব্র পারিপার্শ্বিক চাপ কীভাবে প্রভাবিত করেছে আজাদকে। তিনি ছিলেন এই বাংলাদেশের যত ধরনের অপকীর্তি আছে তার তীক্ষ্ণ পর্য়বেক্ষক ও মুখোশ উন্মোচনকারী একজন কবি-বুদ্ধিজীবী। কিন্তু আজাদ প্রথম দিকে এমন ছিলেন না। তিনি তাঁর প্রথম জীবনে আধুনিকতাবাদী যে নন্দনতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন- সেই ‘শিল্পের জন্য শিল্প’-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে আসেন; হয়ে ওঠেন অনেকটা সামাজিক-দায়বদ্ধ লেখক।

আজাদের উপন্যাসও সমাজ সচেতনমূলক রচনা, পরিপার্শ্বকে নিয়েই এরকমটা হয়ে উঠেছে। অনেকেই তাঁর উপন্যাসে পাশ্চাত্য উপন্যাসের নানা প্রভাবের কথা বলে থাকেন। কিন্তু এই প্রভাব থাকা সত্ত্বেও স্বীকরণে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ওয়ালীউল্লাহ্ও তো প্রকরণ আর দর্শনের দিকগুলি নিয়েছিলেন বাইরে থেকে। এই কথাগুলি বলছি, ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আজাদের উপন্যাস ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’র আলোচনার সুবিধার্থে। তাই কেউ যদি শুধু নাম দেখে আচেবের ‘থিংস ফল অ্যাপার্ট’কে আজাদের ‘সবকিছু ভেঙে পড়ের সাথে মিলিয়ে দেখেন তাহলে ভুল হবে। আজাদ তাঁর এই উপন্যাসের মতো অন্যান্য উপন্যাস : ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল (১৯৯৪), রাজনীতিবিদগণ (১৯৯৮), ১০,০০০, এবং আরো ১টি ধর্ষণ (২০০৩), পাক সার জমিন সাদ বাদ-এ (২০০৪) সমকালীন বাংলাদেশের ব্যাপক নষ্টামিকেই তুলে ধরেছেন। নানা সংকটের ভীষণ দগদগে ক্ষতই যেন তাঁর উপন্যাসে থকথক করছে। আর এই ঘায়ের মলম-মালিশও মাঝে মাঝে দিয়ে গেছেন আজাদ, তাঁর উপন্যাসে।

এছাড়া নানা বক্তৃতায়, নানা বৈঠকি আড্ডায় আজাদ সবসময়ই কঠিন কণ্ঠে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরতেন এবং এসবের সমাধান-প্রকল্পও দাঁড় করাতেন। এই সব বক্তৃতা ও বৈঠকি আড্ডায় উচ্চারিত ভাবনাসমূহ তাঁর লেখালেখিতেও স্পষ্ট; প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। কিন্তু সমস্যা দেখা গেছে তাঁর কবিতা-নির্মাণের বেলায়। আজাদ অন্য সবধরনের রচনায় প্রগতিশীল আর উচ্চকণ্ঠ হলেও কবিতায় হয়ে পড়েছেন কিছুটা কামনাবাসনাতাড়িত, ইন্দ্রিয়মনস্ক, একেবারে আধুনিকতাবাদী। আধুনকিতাবাদী হয়ে যে প্রগতিশীল হওয়া যায় না, তা বলছি না, যায়। কিন্তু আজাদ অতদূর অব্দি যেতে পারেন নি। আজাদ কবিতার বেলায় হয়ে পড়েছেন ইন্দ্রিয়নির্ভর রোমান্টিক কবি। মেদুর ভাবালুতা, তীব্র ভাবাবেগ ধরনের আধুনিকতাবাদী সাহিত্যরীতির মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে তাঁর কবিতা। প্রগতিশীল যে বৈশিষ্ট্য আজাদ তাঁর গদ্যসাহিত্যে ধারণ করেছিলেন, কবিতায় তার প্রতিফলন ঘটেনি। তবে কবিতায় তাৎক্ষণিকতাকে চিরকালীন করে তুলেছিলেন তিনি। সেই জন্য তাঁর কবিতার বহু উচ্চারণ বা পঙক্তি প্রবচনে উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে একথা বললে ভুল হবে না যে, আজাদের লেখায় প্রগতিশীল যে ভাবনার কথা পাওয়া যায়, বহু আগেই ইয়োরোপীয় রেনেসাঁ থেকে এনলাইটেনমেন্টের যুগের মধ্যেই সেসব ভাবনার বীজ সংগুপ্ত ছিল। এমনকি ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন যুগের হিসেবে নিতান্তই পিউরিটান বলে পরিচিত ভিক্টোরীয় যুগটিও প্রাগ্রসর প্রগতিশীল সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করেই এগিয়ে এসেছিল। তবু আজাদ যেহেতু বিশুদ্ধ সোচ্চার প্রগতিবাদী লেখক-বুদ্ধিজীবী হতে চেয়েছিলেন, ফলে, প্রগতিশীল সাহিত্য-প্রকল্পের মাধ্যমেই তিনি তাঁর নিজের সাহিত্যিক পটভূমি নির্মাণ করে নিয়েছিলেন।

আজাদের অন্যান্য লেখা যেমন সবাইকে জাগিয়ে তোলে, জাগ্রত করার লক্ষ্য নিয়েই তিনি লিখতেন, সেটা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যত পুরোনো চিন্তাই হোক, সমকালীন বাংলাদেশে জন্য ছিল নতুন। তার চেয়ে বড় কথা সেসব ভাবনা ছিল সময়ের সাহসী উচ্চারণ। হুমায়ুন আজাদ ছিলেন সময়ের এই সাহসী সন্তান। এ দিক থেকে তাঁকে অনন্য এক ভাবুক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু তাঁর কবিতার কথা যদি ধরি, এই ভাবনার কোনো প্রকাশ দেখি না। আজাদের কবিতা, দু-একটি বাদ দিলে, সম্পূর্ণ রোমান্টিক। সেসব কবিতা হৃদয়ে যতটা আলোড়ন তোলে, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক খেকে জাগিয়ে তোলে না ততটা। হুমায়ুন আজাদ তাঁর শ্রেষ্ঠকবিতা গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন, কবিতা তাঁর কাছে “সৌন্দর্যের বিরামহীন বিস্তার, ইন্দ্রিয়ের অনন্ত আলোড়ন, জীবাশ্মের মতো নির্মোহ মহর্ষির প্রাজ্ঞতা, ধ্যানের অবিচল উৎসারণ, জীবনের আদিম উচ্ছল উৎসব, রূপক প্রতীক চিত্রকল্পের নির্বাণহীন অঙ্গার।” কবিতা সম্পর্কে আজাদের এই উচ্চারণ তাঁর রচনা-সমগ্রের প্রেক্ষাপটে কীভাবে উচ্চারিত হলো, সামান্য হলেও আমাদের ভাবায়। আর সেটা হলো, দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে অন্যান্য রচনায় তিনি যথেষ্ট প্রগতিশীল, কিন্তু কবিতায় আজাদ কীভাবে যেন নাকচ করে দিলেন! কবিতার ব্যাপারে গ্রহণ করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন সাহিত্যাদর্শ; সাথে সাথে তাঁর কবিতা কিছুটা হলেও অপ্রগতিশীল হয়ে গেলেন! একে তাঁর চিন্তাশীলতার দ্বন্দ্ব হিসেবেও আমরা দেখতে পারি। অনেকে বলেন, কবিতায় নাকি ব্যক্তিমানসকে সবচেয়ে ভলোভাবে চেনা যায়। তাহলে? তিনি তো গদ্যে প্রগতিশীল, কবিতায় কেন ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দিলেন? এবার সেই বিশ্লেষণ।

শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ নামে একটা প্রবন্ধগ্রন্থ বেরিয়েছিল ১৯৮৮ সালে; লেখক স্বয়ং হুমায়ুন আজাদ। এই গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধে আজাদ শিল্পের বিমানবিকীকরণ-প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেছেন, ব্যাখ্যা স্পেনের দার্শনিক হোসে অর্তেগা ঈ গাসেৎ-এর লেখার ওপর ভর করে। এই প্রবন্ধে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’, যা অ্যাডগার এলান পো, শার্ল বোদলেয়ার, জ্যঁ আর্তুর র‌্যাঁবোসহ অন্য কবিরাও গ্রহণ করে এই মতকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। একেই বিশেষভাবে উপস্থাপন করেছিলেন আজাদ। এই মতাদর্শ অনুসারে শিল্পকেই প্রধান করে তোলা হয়। শিল্প আর শিল্পের সৌন্দর্যবোধের ব্যাপারটা এখানে সবিশেষ প্রাধান্য পায়, বাদবাকি অন্যান্য বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয় নি। একটু গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যাবে, এই মতের অনুসারী হয়েই কবিতা রচনা করেছেন আজাদ। শিল্পের জন্য শিল্প বলে যারা শিল্পনির্মাণে আগ্রহী হয়েছিলেন, তাদেরকেই স্মরণ করেছিলেন আজাদ; কবিতা নির্মাণের রীতিপদ্ধতি হিসেবে। আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম অলৌকিক ইস্টিমার, প্রকাশিত হয় ১৯৭৩-এর জানুয়ারিতে (পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ)। কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন ১৯৬৮-১৯৭২-এর রাত-দিনগুলোর উদ্দেশে। কোনো মানুষকে নয়, উৎসর্গ করেছেন দিন আর রাতকে! যে কেউ এতে বিস্মিত হবেন! ভাবুন তো, রাত আর দিনের সঙ্গে একজন প্রগতিশীল ভাবুক হিসেবে আলাপ করা যায়, লেখা যায় কিছু? সম্ভব নয়। তবে একেবারেই সম্ভব নয়, একথা বলা যাবে না। অবস্তুবাদী, অর্থাৎ ভাববাদী দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে সম্ভব। এই বইয়ের ‘স্নানের জন্য’ শীর্ষক প্রথম কবিতাটির কথা ধরা যাক। কবি বলছেন, ‘মরুভূমির মতো নদী বয়ে যায় দিকচিহ্নহীন/ আমি কি ক’রে নৌকো জলে নামি / স্নান করি’- ব্যক্তিগত বয়ান, সাথে নিসর্গ, হ্যাঁ ধরলাম নিসর্গ-ই। একবারে একক ব্যক্তির চোখে দেখা নিসর্গ। মিলে যাচ্ছে ফরাসি হওয়া আর তাতে হাবুডুবু খেয়ে বোদলেয়ারের চোখে দেখা ফ্রান্সের সঙ্গে, যা বিশেষভাবে আছে Les Fleurs du mal-এর কবিতাসমূহে; তাই দেখি আজাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতায়, ‘তার স্তবে মগ্ন হ’লে বুঝতে পারি ড্রেনে ড্রেনে পদ্ম ফোটে/ ডাস্টবিনে জন্ম নেয় সূর্যমুখি/ অবশ্য কারো বন্দনা দিতে পারে না তৃপ্তি’। এর মাধ্যমেই প্রতীকবাদী, আধুনিক, নাগরিক, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’- মতাদর্শে বিশ্বাসী বোদলেয়ারের কবিতা আর কাব্যাদর্শের সাথে মিলে যায় আজাদের কবিতা। অলৌকিক ইস্টিমার কাব্যগ্রন্থের আরেকটা কবিতার নাম ‘নৃত্যগীতবিদ্যা’। টি এস এলিয়টের The Love Song of J. Alfred Prufrock-এর পাঠ নিলে যে কেউ ‘নৃত্যগীতবিদ্যা’ কবিতাটিকে এলিয়টের কবিতার সঙ্গে মেলাতে পারবেন। এলিয়ট যে কতটা স্কেপটিক ছিলেন, তা তো এখন আর কারো অজানা নেই।

আধুনিকতাবাদী কবিতার একটি মূল প্রসঙ্গ ব্যক্তিসর্বস্বতা বা ব্যক্তিনির্ভরতা। যেহেতু আধুনিকতার সূচনায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের একটা বড় ভূমিকা ছিল। ফলে, আধুনিকতাবাদী সাহিত্যাদর্শ আধুনিক আমলের ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়কে সবচেয়ে বেশি প্রধান্য দেয়। কিন্তু, সেই ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত আদর্শের সাথে কি আজাদের প্রগতিশীল সাহিত্যাদর্শের কোনো মিল পাওয়া যাবে? প্রগতিশীলতা তো কোনো ব্যক্তিক বিষয় নয়, সামষ্টিক চিন্তার বৃহৎ ফলাফল একত্রিত না হলে তো তা প্রগতিশীল হয়ে ওঠে না। দু’একটি কবিতা বাদ দিলে আজাদের সমগ্র কবিতাই গাসেৎপন্থী ভাবাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত বলে মনে হয়।

আজাদের কাব্যগ্রন্থ জ্বলো চিতাবাঘ প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে। এই কাব্যে আধুনিকতাবাদের প্রাধান্য দেখা গেছে ‘নিসর্গ-নির্মাণ-প্রকল্প’ কবিতায়। এই কবিতাতেই চোখে পড়বে রঙের ব্যবহারে ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে তোলার চমৎকার প্রচেষ্টা। তবে সেই প্রচেষ্টা ইন্দ্রিয়কে ছাপিয়ে আর এগোতে পারেনি। কিন্তু এগোনো দরকার ছিল আজদের; প্রগতিশীল মনোভঙ্গি আর আদর্শকে প্রকাশের জন্য। যেমন আজাদ বলছেন, ‘রক্তলাল হৃৎপিণ্ড হলদে ক্ষিপ্র মৃত্যুপ্রাণ বুলেট প্রবেশ;/ অগ্নুৎপাতমগ্ন দ্বীপ, চিতার থাবায় গাঁথা ব্যাধ ও হরিণ।’ এই কবিতা, আমি যা বলতে চাইছি তার সঙ্গে মিলে যায়। কেউ কেউ বলবেন. কবিতা তো ভিন্ন সাহিত্য-মাধ্যম, অন্যান্য সাহিত্য-মাধ্যম থেকে আলাদা। মানছি একথা। কিন্তু তার পরেও দেখতে পাচ্ছি, প্রগতিশীল সাহিত্যাদর্শ থেকে আজাদ সরে এসেছেন ভাববাদী রোমান্টিকতায়। বলা বাহুল্য, রোমান্টিকতাও একসময় প্রগতিবাদী চিন্তা হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। বিপ্লবীরাও এক অর্থে রোমান্টিক। রোমান্টিক ভাববাদ তাই কবিতায় থাকতে পারে, কিন্তু তাতে ব্যক্তিরই প্রাধান্য, এমনকি ব্যক্তিসর্বস্বতাই প্রধান হয়ে ওঠে। আধুনিক সমাজ ও ব্যক্তিমানসের অবক্ষয়, নৈঃসঙ্গ্য, একাকীত্ব, বিষাদ, অপ্রাপ্তির হাহাকার, যৌনতা আর প্রেমিক বা প্রেমাস্পদের জন্য তীব্র আর্তি- এসবই আধুনিকতার লক্ষণ। এই কবিতা ততটাই প্রগতিশীল যতটা ব্যক্তিক। সামষ্টিক উত্তরণের কথা এতে স্থান পায় না। হুমায়ুন আজাদও লিখেছেন ঠিক এই ধরনের কবিতা।

তবে প্রগতির কথা না থাকলেও এসব কবিতায় ভীষণ সুন্দর সুন্দর চিত্রকল্প তৈরি করেছেন আজাদ। অনেকটা পরাবাস্তববাদী প্রক্রিয়ায় নির্মিত বেশকিছু চিত্রকল্প আমাদের ইন্দ্রিয়ের অনুভবকে তীব্র করে তোলে। কিন্তু আজাদের প্রধানতম সাহিত্যাদর্শ ‘প্রগতিশীলতা’কে তা নাকচ করে দেয়। মুত্যুবোধ আর ব্যক্তিক যন্ত্রণাবোধের যুগপৎ সম্মিলন ঘটেছে জ্বলো চিতাবাঘের ‘পোশাকপরিচ্ছদ’, ‘প্রেমিকার মৃত্যুতে’, ‘পাড়াপ্রতিবেশী’ শীর্ষক নানা কবিতায়। এই ব্যক্তিক দুঃখবোধ এবং মৃত্যুচেতনা, এবং যার উদ্ভব ঘটেছে সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে, তা থেকে বাঁচতেই বোদলেয়ারেরা হেঁটেছেন নিসর্গের দিকে। এরকম সবুজ বনানী প্রান্তরের কথা আছে ফেদরিকো গার্সিয়া লোরকার কবিতাতেও। কিন্তু তাঁরা দুজনেই আধুনিকতাবাদী কবি এবং এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কবি। কিন্তু বোদলেয়ার ও লোরকার নিসর্গ দেখার চোখ দিয়ে নিসর্গকে দেখার ফলে আজাদের কবিতা অনেকটাই ওই দুই কবির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে; যে প্রগতিশীল ভাবনার জন্যে তিনি গদ্য লিখে সমাদৃত হয়েছেন, সেই প্রগতিচিন্তার কথা তাঁর কবিতায় সেইভাবে আসেনি। কবিতায় আসলে তিনি দুর্মর এক প্রেমিক, ভাবালু, আবেগাক্রান্ত। এসব দিক থেকে তাঁর কবিতাকে অবশ্যই সার্থক বলতে হবে। ফলে কবিতায় আজাদ তাঁর মূল প্রগতিশীল ভাবনা থেকে সরে গিয়ে বিচ্ছিন্নতার চর্চা করেছেন।

বোদলোয়ার তাঁর ক্লেদজ কুসুমকে যে সাহিত্যাদর্শ নিয়ে কবিতা করে তুলেছেন, ঠিক সেইভাবে তাঁর অন্তরঙ্গ ডায়েরিতেও একই সাহিত্যাদর্শ নিয়ে লিখেছেন ছোট ছোট প্রবন্ধ। কিন্তু আজাদ এই ব্যাপারটা রক্ষা করতে পারেন নি। মাঝে মাঝে আজাদের কবিতা পাঠ করলে তীব্রভাবে কীটসের কবিতার স্বাদ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, আজাদের কবিতা রোমান্টিকদের কবিতার মতোই রোমান্টিক হয়ে উঠেছিল। তাঁর কবিতা থেকে উদাহরণ দেই : ধ’সে পড়েছে অজেয় পর্বত, সূর্য ছুটে এসে ভেঙে পড়ছে/ আমার তরল মাংসে, আগুন জ্বলছে, অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে,/ যেখানে পাখির ডাক নেই, নেই এক ফোঁটা তুচ্ছ শিশির।/ অনেক অভিজ্ঞ আমি, মৃতদের সমান অভিজ্ঞ। এই প্রসঙ্গটা আরো বেশি স্পষ্ট হয় স্থানিকতার কথা উল্লেখ করলে। রবার্ট ফ্রস্ট তাঁর কবিতায় আমেরিকার মিড-ইংল্যান্ডকে এনেছেন। বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো এনেছেন প্যারি-ফ্রান্সকে। হিমেনেথ, লোরকা এনেছেন স্পেনের আন্দালুসিয়াকে। কিন্তু এঁরা কেউই এই সমস্ত স্থানকে শুধুমাত্র নস্টালজিক করে রাখেননি। কিন্তু আজাদ তাঁর জন্মস্থান রাঢ়িখালকে এনেছেন নিছকই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে, যা রোমান্টিক কবিতারই ভাবাদর্শ বলা যায়।

প্রথাগত আধুনিকতাবাদীদের প্রকরণের সঙ্গেও ঠিকঠাক মিলে যায় আজাদের কবিতা। স্তবকবিন্যাস, ছন্দ নির্মাণে আজাদের কবিতায় তেমন বিশেষ কোনো বৈচিত্র্য চোখে পড়ে না। তবে চমক এনেছেন অন্য জায়গায়, কৈশোরক কবিতায়- কী বিষয়বৈচিত্রে, কী গীতিধর্মী ছন্দে, কী ভাবাবেগের দিক থেকে।

শেষ আলাপ, অর্থাৎ এই লেখাটা শেষ করি এই বলে যে, কে কেমন কবিতা লিখবেন সেটা তাঁর একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। প্রত্যেক লেখকেরই ব্যক্তিগত সাহিত্যাদর্শ থাকে। হুমায়ুন আজাদেরও আছে। সেটা নিঃসন্দেহে প্রগতিবাদী চিন্তাপ্রসূত। কিন্তু আজাদের প্রবন্ধ ও উপন্যাসের ভাবাদর্শের মধ্যে অন্তর্গত গভীর মিল আছে, নেই কেবল কবিতার সঙ্গে। এখানে তাঁকে তাঁর নিজের ভাবনার দিক থেকেই দলছুট মনে হয়। নিজের প্রগতিবাদী চিন্তাকে তিনি কবিতায় রোমান্টিক ভাবালুতার দিকে নিয়ে গেছেন। চিন্তার এই দ্বন্দ্বের কোনো নিরসন তিনি ঘটাতে পারেননি, হয়তো ঘটাতে চানও নি। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, কবিতা হিসেবে তাঁর কবিতা সুখপাঠ্য, কিন্তু ভাবনার দিক থেকে প্রবন্ধ-উপন্যাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে সবমিলিয়ে তিনি যে প্রগতিশীল ভাবনাকে সাহসের সঙ্গে ‍উচ্চারণ করেছিলেন, অকপটে নির্ভয়ে ব্যক্ত করতেন, যার কারণে তাঁর জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়েছিল; শুধু এই কারণে তাঁর ভাবনা-চিন্তার প্রভাব থেকেই যাবে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা তাঁকে প্রতিনিয়তই স্মরণ করবেন।

লেখক:
শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক লেকচারার, বাংলা বিভাগ, বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।