ইসলাম : শান্তি ও সম্প্রীতির বিশ্বজনীন জীবন বিধান

মহান আল্লাহ সৃষ্টি সংক্রান্ত তাঁর ক্ষমতা বিষয়ে বলেন- ‘ইন্নামা আমরুহু ইযা আরাদা শাইয়ান আয়্যাকুলা লাহু কুন ফায়াকুন’ অর্থাৎ তাঁর (আল্লাহর) আদেশ শক্তি এমন যে, তিনি যখন কোনো কার্য সম্পন্ন করার ইচ্ছে পোষণ করেন, তখন শুধু বলেন হয়ে যাও, আর তা সাথে সাথেই হয়ে যায় (সুরা ইয়াসিন, আয়াত-৮২)। তিনি আকাশ-জমিন সৃষ্টি করলেন। এতদুভয়ের বাসিন্দা হিসেবে ফেরেশতা ও জিন সৃষ্টি করলেন। কিন্তু এদের কেউই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন হতে পারেনি। সর্বত্র শূন্যতা, অপূর্ণতা; যা দূরীভূত হয় আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমে। ফেরেশতাকুলের মতামতকে প্রাধান্য না দিয়ে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করলেন ধরাপৃষ্টের প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-কে; এবং তাঁকে ঘোষণা করলেন সৃষ্টি-জগতের শ্রেষ্ঠ মাখলুক হিসেবে।

আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা প্রদান করা হলো আদম (আ.)-কে, এতে করে কেউ কেউ নাখোশ হল; বিশেষ করে অভিশপ্ত শয়তান তাঁর পিছু লেগে গেল এবং বিভ্রান্তির বক্ররেখায় পেচিয়ে তাঁকে জান্নাত থেকে বিতাড়নের সব ব্যবস্থা করল। সৃষ্টির প্রথম মানব-যুগল হিসেবে আদম (আ.) ও তাঁর সঙ্গীনী হাওয়া (আ.) ধুলির ধরায় পা রাখেন। স্বর্গ থেকে তাঁদের অবতরণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে মানুষের যাত্রা শুরু হয়। মহান আল্লাহ তাঁদের ও তাঁদের পরবর্তীতে যারা আসবেন সকলের জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দেন; যার আলোকে মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনাচার পরিচালনা করবে। এর নাম হেদায়েত, যা অনুসরণ করলে মানবজীবনে কোনো প্রকার ভীতি থাকবে না এবং মানুষেরা কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হবে না (সুরা বাকারা, আয়াত-৩৮)। বিশ্বে মানবজাতির ঐতিহাসিক এই যাত্রালগ্নেই ইসলামের শুভসূচনা ঘটে, পরবর্তীতে তারই ক্রমধারায় এ ভূপৃষ্ঠে নানা সময়ে প্রয়োজনীয়তার নিরিখে লক্ষাধিক নবী-রাসুলের আবির্ভাব ঘটে; যাঁদের সকলের মূল সুর ছিল এক ও অভিন্ন।

ইসলামের পবিত্র মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘ওয়ালাকাদ বাআসনা ফি কুল্লি উম্মার্তি রাসুলা’ অর্থাৎ আর অবশ্যই আমরা প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি (সুরা নাহল, আয়াত-৩৬)। পৃথিবীতে নবী-রাসুল প্রেরণের এই ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন পয়গম্বর হলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.); ইসলামি জীবনবোধে উজ্জীবিত তাবত মানুষের কাছে তিনি মুসলিম মিল্লাতের পিতা হিসেবে স্বীকৃত। মহান আল্লাহ ও তাঁর সকল নির্দেশের একান্ত ফরমাবরদার হিসেবে ইব্রাহিম (আ.)-এর আনুগত্য আমাদের কল্পনাকেও হার মানায়। পরম স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির বিশ্বাস ও আনুগত্যের মস্তক কতটুকু অবনত রাখতে হয়- বিশ্ব-ইতিহাসে ইব্রাহিম (আ.) তারই অবিশ্বাস্য সব নজির স্থাপন করে গেছেন। ইসলাম যদি হয় মহান আল্লাহর কাছে সত্যিকারের আত্মসমর্পণের ধর্ম, তবে ইব্রাহিম (আ.) জীবনের অপরিসীম ত্যাগ ও কুরবানির মাধ্যমে বহুবার সেই আত্মসমর্পণের অনবদ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন।

স্বয়ং মহান আল্লাহ তাঁর এ আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণা করছেন- ‘ওয়া ইযিবতালা ইবরাহিমা রাব্বুহু বিকালিমাতিন ফাআতাম্মাহুন্না’ অর্থাৎ ইবরাহিম (আ.)-কে অনেক বিষয়ে তাঁর প্রতিপালক পরীক্ষা নিয়েছেন, অতঃপর তিনি আনুগত্যের সকল পরীক্ষায় যথাযথভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন (সুরা বাকারা, আয়াত-১২৪)। এরই পুরস্কার স্বরূপ মহান আল্লাহ তাঁকে গোটা মানবজাতিকে নেতৃত্ব দানের জন্যে নির্বাচিত করলেন- ‘কালা ইন্নি জায়িলুকা লিন্নাসি ইমামা’ অর্থাৎ নিশ্চিত রূপে আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির নেতা বানাব (সুরা বাকারা, আয়াত-১২৪)।

পরবর্তীতে তাঁরই বংশধারায় মহান আল্লাহর মনোনীত দূতদের আগমণের ভেতর দিয়ে বস্তুত এই ঘোষণাই বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছিল। আর ইসলামের ইতিহাসে ইবরাহিম (আ.)-এর স্থান অনেক ঊর্ধ্বে- ‘মিল্লাতা আবিকুম ইবরাহিমা হুয়া সাম্মাকুমুল মুসলিমিন’ অর্থাৎ তোমাদের মিল্লাতের পিতা হলেন ইবরাহিম; তিনিই তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলমান (সুরা হাজ্ব, আয়াত-৭৮)। ইবরাহিম (আ.)-এর প্রিয়তমা পত্নী হজরত হাজেরার গর্ভস্থ কৃতি সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর অধঃস্তন বংশ পরম্পরায় আগমণ করেন মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামনীষী ও সর্বশেষ নবি-রাসুল হজরত মোহাম্মদ (সা.); যাঁর মধ্য দিয়েই ইসলাম পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং পৃথিবীতে আগত নবুয়তি কাফেলারও পরিসমাপ্তি ঘটে।

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আরব উপদ্বীপে তখন চলছে ভয়াবহ দুঃসময় ও অরাজকতা। সভ্যতা, মানবতা ও ন্যায়ের স্থলে কল্পনাতীত হিংস্রতা ও পশুত্বের কৃষ্ণ আবরণে ঢেকে গিয়েছিল গোটা সমাজব্যবস্থা। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ নীতি প্রচলিত ছিল সর্বত্র; মানুষের স্বাধীনতা ও ন্যূনতম অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার পরিবেশও ছিল অনুপস্থিত। নারীদের কোনো সামাজিক মর্যাদা স্বীকৃত ছিল না; বরং কন্যা সন্তানদের ভুমিষ্ট হওয়ার পরক্ষণেই পাষন্ডের মতো মৃত্তিকা-গহ্বরে পুঁতে ফেলা হতো, জীবন্ত কবর দেয়া হতো। ইতিহাসের ভাষায় একে ‘অন্ধকারের যুগ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশ্বসভ্যতার এ মহাবিপর্যয় রোধকল্পে এবং শান্তিময় ও মানবিক পৃথিবী নির্মাণের ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তখনই ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বরের আবির্ভাব আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে।

অবশেষে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মানবতার ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বিশ্বনবি মোহাম্মদ (সা.) বিশৃঙ্খল ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মরুময় আরব সমাজে মহান আল্লাহর মনোনীত ও প্রেরিত ঐশী দূত, বার্তাবাহক তথা রাসুল হিসেবে আগমণ করলেন। পারস্যের আধ্যাত্মিক কবি ফরিদুদ্দিন আত্তার গেয়েছেন- ‘সাইয়েদুল কাউনাইন ও খাতমুল মুরসালিন, আখের অমাদ বুদ ফাখরুল আউয়ালিন’ অর্থাৎ তিনি হলেন ইহকালীন ও পারলৌকিক উভয় জাহানের সর্দার এবং সর্বশেষ প্রেরিত রাসুল। পৃথিবীতে তাঁর আগমণ সকল নবি-রাসুলের শেষ পর্যায়ে হলেও তিনিই ছিলেন সৃষ্টির প্রথম গৌরব।

ইসলামি জীবনবোধ ও ধর্মবিশ^াস অনুযায়ী মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের কাছে ‘রব’ হিসেবে স্বীকৃত। কুরআনে কারিমে বলা হয়েছে- ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’ অর্থাৎ যাবতীয় প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর, যিনি জগতসমূহের রব তথা পালনকর্তা (সুরা ফাতিহা, আয়াত-১)। রব-এর অনেক সংজ্ঞা রয়েছে, তবে সহজবোধ্য সংজ্ঞায়নে আমরা বলতে পারি- ‘কুল মাখলুকের যা কিছু প্রয়োজন, সবকিছুরই যিনি করেন আয়োজন, তিনিই হলেন রব। এ হিসেবে মহান আল্লাহ জানেন যে, সৃষ্টিজগতের কল্যাণে কখন কি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ধরনী যখন পাপের ভার আর সইতে পারছিল না, ঠিক তেমনি এক সন্ধিক্ষণে মানবতার পরম বন্ধু ও ত্রাণকর্তা হিসেবে মহানবি (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটে।

শৈশব আর কৈশোরেই তিনি মহৎ সব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ধারক হয়ে ওঠেন। যৌবনে অমিত সম্ভাবনার শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ব্রতী হন। পরিণত বয়সে মহান রবের নির্বাচিত সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বরের সুউচ্চ অবস্থান থেকে মানুষ ও মানবতার কল্যাণে করণীয় সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমাজ থেকে অন্যায়, পাপাচার ও সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করেন। খোদাপ্রদত্ত জ্ঞান, অলৌকিকত্ব ও শক্তিমত্তা দিয়ে হেকমত, প্রজ্ঞা ও কৌশলের ভিত্তিতে ইসলামকে এক উদার, সহনশীল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও প্রেমময় ধর্ম হিসেবে রূপ দিতে সক্ষম হন।

আরবে তখন নানা ধর্মমত প্রচলিত ছিল। পবিত্র কাবার অভ্যন্তরে ছিল ৩৬০টি মূর্তি। এতদ্সত্ত্বেও তখনকার সমাজে কিছু লোক এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল, যাদেরকে ‘হানিফ’ হিসেবে অভিহিত করা হতো। তবে ধর্ম না মানা, অশ্লীলতায় নিমজ্জমান থাকা ও পাপাচারে লিপ্ত মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি; যারা নিজেদের বাপ-দাদার মত-পথকেই তাদের জীবনাচারে অধিক প্রতিফলন ঘটাতো। প্রকৃত সত্যকে গ্রহণ করা, নতুন কিছু মেনে নেয়ার মানসিকতা, ইনসাফ, আদল, সাম্য-মৈত্রী আর শান্তি-শৃঙ্খলার প্রতি আগ্রহ এবং মানুষের প্রতি মানুষের দরদ ও দায়বদ্ধতা ছিল একেবারেই অনুপস্থিত।

আরব-সমাজের এমনই প্রেক্ষাপটে মহানবি (সা.) তাঁর পরম রবের একত্ববাদের দাওয়াতে মশগুল হন। আর সাথে সাথেই প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কোপানলে পতিত হন। ভালো কথা শোনা, ভালো কাজ করা আর ভালো কিছু গ্রহণ করার প্রবণতা যাদের ছিল না, তারা কিভাবে এই নতুন কালেমার আহ্বানে সাড়া দেবে! ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই আর মোহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন আল্লাহর প্রেরিত রাসুল’এই পরম সত্য ও শাশ^ত বাক্যের প্রতি আনুগত্য পোষণ তো করলই না, বরং মহানবি (সা.)-কে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করল; এমনকি তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করল। তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করলেন এবং নব-আঙ্গিকে ইসলামের জ্যোতি বিকিরণের প্রয়াসে ব্রতী হলেন।

আত্মরক্ষামূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রেখে ইসলামের দাওয়াত, প্রয়োজনের তাগিদে নানা অভিযান, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্মুখ সমর মোকাবেলা এবং কখনো চুক্তি ও সন্ধির মাধ্যমে ইসলামের বিজয় রথ চলমান রাখেন। এক দশকের ব্যবধানে পরিস্থিতির আমুল পরিবর্তন ঘটে। নিজের জন্মস্থান যেই মক্কায় তাঁকে থাকতে দেয়া হয়নি সেই মক্কা তিনি বিজয় করেন, বিজয়ী বেশে তিনি দলবলসহ মক্কায় প্রবেশ করে বিশাল ক্ষমা ও ঔদার্যের পরিচয় দেন। মদিনা ও মক্কাসহ গোটা জাজিরাতুল আরব তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, শুধু যে বিশাল ভূখন্ডের অধিপতি হলেন তাই নয়, মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন ও সংশোধনেও তিনি সর্বোতভাবে সফল হন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় মানুষের বাহ্যিক আচার-ব্যবহার ও চারিত্রিক উৎকর্ষ যেমন সাধিত হয় তেমনি তাদের আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আধ্যাত্মিক বিকাশও ঘটে। তাঁর অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা ও গুণাবলির মাধুর্যে জেহালতের যুগের সকল অন্ধকারাচ্ছন্নতার অবসান হয় এবং মানুষেরা তাঁর জ্ঞানের আলোক-স্পর্শে সভ্য, নির্লোভ, বিনম্র ও সংস্কৃতিমনস্ক হয়ে ওঠে। গোটা সমাজের চিত্রটাই পাল্টে যায়; কেউ আর কারো অনিষ্ট চায় না, সকলেই অপরের হিত-সাধনে তৎপর থাকে। বরঞ্চ অন্যের স্বার্থরক্ষায়, পরোপকারে ও মানবহিতৈষী কার্যক্রমে পরস্পর পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। এসবই সম্ভব হয় কল্যাণময় জীবনব্যবস্থা ইসলামের মহান দৌলত ও বরকতে।

প্রবন্ধের শিরোনামে আমরা দুটি মুখ্য বিষয় সংযোজন করেছি। প্রথমত, বিশ্বজনীন এবং দ্বিতীয়ত, শান্তি ও সম্প্রীতি; অর্থাৎ ইসলাম সত্যিকার অর্থে শান্তি ও সম্প্রীতির এক অতুলনীয় ও বিশ্বজনীন জীবন বিধান। বস্তুতপক্ষে, ইসলামের আবির্ভাবই ঘটেছে অশান্তি, সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য। ইসলাম মানেই শান্তি, ইসলাম মানেই আত্মসমর্পণ; আর সেই আত্মসমর্পণও পরম শান্তির কাছে। পরম শান্তির উৎস মহান আল্লাহ; সেজন্য তাঁর নাম ‘সালাম’ তথা শান্তিদাতা। সমাজবদ্ধ মানুষের মাঝে এই শান্তি বিরাজমান থাকার লক্ষ্যেই ইসলাম পরস্পরের মধ্যে সালামের বিধান জারি করেছে; যখন কেউ কারো সাক্ষাতে মুখোমুখি হয় তখন বলে ওঠে ‘আস্সালামু আলাইকুম’ অর্থাৎ আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামের মৌল আকাক্সক্ষাই হলো শান্তির শীতল ছায়ায় আচ্ছাদিত হওয়া; আর তার পরিম-ল কেবল নিজস্ব গন্ডির ভেতরকার সংকীর্ণ ও নির্দিষ্ট স্থান-পাত্র নয়, বরং তা সর্বব্যাপী বিস্তৃত। এখানে ফরাসি বিশ্বখ্যাত ফুটবলার পল পগবার (জন্ম- ১৫ মার্চ, ১৯৯৩ খ্রি.) অতি সম্প্রতি এক মন্তব্যের অংশবিশেষ তুলে ধরছি- ‘মানবতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ইসলাম জীবন সম্পর্কে আমার ধারণা বদলে দিয়েছে, আমার চোখ খুলে দিয়েছে, আমাকে ভালো মানুষে পরিণত করেছে, আমার ভেতরে প্রত্যাশিত শান্তি এনে দিয়েছে এবং আমার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিয়েছে (সুরা আরাফ, আয়াত-১৫৮)। প্রকৃত অর্থে ইসলামের শান্তি-সম্প্রীতির পরিম-ল গোটা সৃষ্টিলোক ব্যাপী বিস্তৃত; জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্বমানবতা এ শান্তি-সমুদ্রে অবগাহনের অধিকার সংরক্ষণ করে।

সম্প্রীতি ইসলামের চিরায়ত আদর্শ। বিশেষ করে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে ইসলাম বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মহানবি (সা.) হলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম উদাহরণ; ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, পরিবার ও সমাজে, নানা জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে এবং বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে তিনি সম্প্রীতির অনবদ্য নজির রেখে গেছেন। এক্ষেত্রে মদিনার মসজিদে রাসুল (সা.)-এর উপস্থিতিতে একজন অমুসলিম কর্তৃক মলমুত্র ত্যাগের ঘটনাটি সামনে আনা প্রাসঙ্গিক হবে; যেখানে সর্বোচ্চ ভক্তি-কেন্দ্র উপাসনালয় অপবিত্র করার পরেও মহানবি (সা.) সেই ব্যক্তির সাথে রূঢ় ব্যবহার করেননি, তাকে কোনো আঘাত করতে দেননি এবং কাউকে ধমকি কিংবা বকা লাগাতেও অনুমতি দেননি।

তিনি নিজেও সেই ব্যক্তিকে কোনোরূপ কটাক্ষ করেননি, বরং সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছেন- এটি আমাদের ইবাদতের স্থান; এখানে ময়লা করলে তা আমাদের হৃদয়কে বেদনাহত করবে, আমরা অত্যধিক কষ্ট পাবো। তাই ভবিষ্যতে আর মসজিদে এমনটি করবে না- এই বলে যখন আগন্তককে বিদায় দেবেন তখনই সে বলে উঠলো, আমি তো আখেরি নবির এই ধৈর্য পরীক্ষা করার জন্যই এখানে এসেছি এবং এই কাজ করেছি; কেননা আমি জেনেছি, শেষ নবি যিনি হবেন তিনি চরম ধৈর্যধারণকারী ও সহনশীল হবেন।

আমি সেটার প্রমাণ পেয়ে গেছি, তাই আর কোনো বিভ্রান্তির অবকাশ থাকলো না; আমাকে পড়িয়ে দেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’। মূলত মহানবি (সা.)-এর চারিত্রিক-মাধুর্যে এই সম্প্রীতির অমূল্য বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকার ফলেই অসংখ্য মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের ঘটনাও এখানে বেশ প্রণিধানযোগ্য; যেখানে সম্পূর্ণ বিজয়ী বেশে প্রবেশের পরেও তিনি তাঁর সাথে কৃত অতীতের জঘন্য কর্মযজ্ঞের প্রতিশোধ না নিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ আর দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে সর্বত্র এক সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে ইসলাম এক দ্রুত বিস্তার লাভ করা ধর্ম তথা ঐশী জীবন বিধানে পরিণত হয়েছিল। আমরা প্রবন্ধের শিরোনামে ইসলামকে শান্তি ও সম্প্রীতির বিশ্বজনীন এক জীবন বিধান হিসেবে উল্লেখ করেছি। প্রকৃতপক্ষে এটি বস্তুনিষ্ঠও বটে; ইসলাম বাস্তবিক অর্থেই সর্বজনীন, বিশ্বজনীন।

পবিত্র কোরআনে মহানবি (সা.)-এর আবির্ভাব বিষয়ে বলতে গিয়ে উল্লিখিত হয়েছে- ‘কুল ইয়া আইয়ুহান্ নাস ইন্নি রাসুলুল্লাহি ইলাইকুম জামিআ’ অর্থাৎ হে রাসুল! আপনি বলুন, আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসুল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।

এ আয়াতে সুস্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, মহানবি হজরত মোহাম্মদ (সা.) নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল, কোনো সম্প্রদায় বা কোনো একটা জাতি-গোষ্ঠীর জন্য প্রেরিত হননি; তিনি ছিলেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল মানুষের নবি ও রাসুল। অতি সম্প্রতি আধুনিক ভারতের শীর্ষ হিন্দু ধর্মীয় গুরু ও পন্ডিত শ্রী আচার্য প্রমোদ কৃষ্ণ (জন্ম-২ জুলাই ১৯৬২ খ্রি.) এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- ‘মোহাম্মদ (সা.) যেমন তোমাদের (মুসলমানদের) ঠিক তেমনি আমাদেরও (হিন্দুদের)। নবি মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনাদর্শ শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, বরং হিন্দুদের জন্যও তিনি এক উজ্জ্বল আদর্শ। তিনি মুসলমানদের পরস্পরের মাঝে সালামের প্রচলন করেছেন, যার অর্থই হচ্ছে শান্তি বর্ষিত হওয়া। তাঁর প্রচারিত ইসলামই শান্তির ধর্ম; যে ধর্মের নবি সহিংসতা পছন্দ করেন না, সেই ধর্মের অনুসারীরা কখনোই সন্ত্রাসী হতে পারে না। তাই কোনো সন্ত্রাসীই মুসলিম হতে পারে না।

এরপরেও কেউ হয়ত নবি মোহাম্মদ (সা.)-কে, তাঁর জীবনাদর্শকে মানবে, আবার কেউ হয়ত মানবে না- এটা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। এমতাবস্থায় কোরআনে কারিম বলছে- ‘ফামান তাবিআ হুদায়া ফালা খাউফুন আলাইহিম ওয়ালা হুম য়াহযানুন’ অর্থাৎ যারা আল্লাহর নির্দেশিত হেদায়েতকে মেনে চলবে তাদের কোনো ভয় থাকবে না আর তারা কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্থও হবে না (সুরা বাকারা, আয়াত-৩৮)। আল্লাহর নির্দেশ হলো- ‘মা আতাকুমুর রাসুলু ফাখুযুহু ওয়ামা নাহাকুম আনহু ফান্তাহু’ অর্থাৎ রাসুল তোমাদের জন্য যা কিছু নিয়ে এসেছেন সেগুলো ধারণ করো, মেনে চলো আর যেসব বিষয়ে তিনি তোমাদের নিষেধ করেছেন সেগুলো থেকে বিরত থাকো (সুরা হাশর, আয়াত-৭)।

মূলত সকল জাতি-গোষ্ঠী ও তাবত ধর্মমতের মানুষের কাছে একজন মহামানব তখনই গ্রহণযোগ্য হবেন যখন তাঁর মাঝে বিকশিত হবে অনুপম বৈশিষ্ঠ্যাবলি; থাকবে গোটা সৃষ্টিলোকের জন্য মহত্তম আদর্শ। আর সেটিই ছিল মহানবি (সা.)-এর অস্তিত্ব জুড়ে- ‘লাকাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ’ অর্থাৎ তোমাদের জন্য রাসুলের জীবনের ভেতরেই রয়েছে অনুসরণীয় সুন্দরতম আদর্শ (সুরা হাশর, আয়াত-৭)।

আর অনুপম আদর্শের বৈশ্বিক মানদন্ডে উত্তীর্ণ বলেই তাঁকে বিশ্বনবি তথা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য নবি ও রাসুলে হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য তাঁর জীবন ও কর্মের মাঝেই নিহিত রয়েছে অনুকরণীয় মহত্তম জীবনাদর্শ। তাই তাঁকে সকল বিতর্কের উর্ধ্বে রাখা যেমন ইসলামি জীবন-দর্শনে নির্দেশিত, ঠিক অপরাপর শান্তিকামী ও মানবতাবাদী মানুষের কাছেও এটি অতীব গুরুত্বের সাথে পালনীয়। এমনকি মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসৃত নীতি-পদ্ধতির ব্যাপারে কোনোরূপ কটূক্তি করার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইট্স এক রুল জারি করেছে- এমনকি এ বিষয়ে অস্ট্রিয়ার আদালতে সাত জন বিজ্ঞ বিচারকের রায়েও বলা হয়েছে, মহানবি মোহাম্মদ (সা.)-এর বিষয়ে কোনো কটূক্তি করা যাবে না।

এ রায়কে পুরোপুরি সমর্থন জানিয়ে ECHR বরং আরো শক্ত ভাষায় সকলকে সতর্ক করে ২৫ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে প্রদত্ত রুল-এ বলেছে- সামাজিক ও ধর্মীয় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নবি মোহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কোনো কটূক্তি করা যাবে না; এটা অন্যায় বলে সাব্যস্ত হবে।The European Court of Human Rights (ECHR) ruled against defamation of Prophet Muhammad (PBUH) and said such activities exceed the permissible limits of freedom of expression. The court’s decision comes after an Austrian national named Mrs. S. held two seminars in 2009, in which she defamed the Holy Prophet (PBUH). According to this latest judgment, defaming the Islamic prophet Muhammad, even if inadvertently, is quite simply always unacceptable, regardless of the language

আমরা এখানে মহানবি (সা.)-এর অবমাননা বা তাঁর প্রতি কটূক্তির বিষয়টি এ জন্য অবতারণা করলাম যে, ঠিক এই কারণে এমনকি কোনো কোনো মুসলিম দেশেও সামাজিক ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়; যা ভয়াবহ দাঙ্গা ও মানবিক বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দেয়। এহেন অনাকাক্সিক্ষত বিপর্যয় রোধ করতেই ইউরোপিয় দেশসমূহের আদালত ও মানবাধিকার সংগঠনসমূহ যথোপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে; যার প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে মানবসমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও জাতিগত বিদ্বেষ-বিভাজনের রেখা মোচন করে দেয়া।

বর্তমান বিশ্বে অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাস। ইসলামের আবির্ভাবকালীন সময়েও যুগের ক্রমধারায় সমাজে সন্ত্রাস ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার ব্যাপকতা ছিল। কিন্তু সেই সমাজের ভীতিকর পরিস্থিতির অবসানকল্পে মহান আল্লাহ আরবের কুরাইশদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছিলেন- ‘ফাল য়াবুদু রাব্বা হাযাল বাইতিল্লাযি আতআমাহুম মিন জুইন ওয়া আমানাহুম মিন খাউফ’ অর্থাৎ তোমরা এই ঘরের (কাবা শরিফ) মালিকের (আল্লাহর) ইবাদত করো; তবেই তিনি তোমাদের ক্ষুধায় অন্ন এবং ভীতির সময় নিরাপত্তা দেবেন (সুরা কুরাইশ, আয়াত-৩-৪)।

বাস্তবেও তাই হয়েছিল। ইসলামকে মেনে চলার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অভাব দূর হয়ে গিয়েছিল আর সন্ত্রাসের বিভীষিকাপূর্ণ পরিস্থিতি আমূল পরিবর্তিত হয়ে সমাজে পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা বন্ধ হয়েছিল এবং সমাজে মানব-সৃষ্ট বিপর্যয় একেবারেই শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল।

মহান আল্লাহর ঘোষণা- ‘মান কাতালা নাফসান বিগাইরিন নাফসিন আও ফাসাদিন ফিল র্আদ ফাকাআন্নামা কাতান্নাসা জামিআ’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যতিত অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকেই হত্যা করলো (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩২। মানব হত্যার বিষয়ে কঠোর সতর্কবার্তা ঘোষণার অব্যবহিত পরেই মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘ওয়া মান আহয়াহা ফাকাআন্নামা আহয়ান্নাসা জামিআ’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো একজনের জীবন বাঁচাল সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষের জীবনই রক্ষা করলো (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩২)।

পবিত্র কোরআনের বাণীর পাশাপাশি এ বিষয়ে মহানবি (সা.)-এর হাদিস শরিফে রয়েছে- ‘পৃথিবীর সকল মানুষ মিলে যদি নিরাপরাধ কোনো একজন মানুষকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এর ফলশ্রুতিতে মহান আল্লাহ সকল মানুষকেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত করবেন; তথাপিও অন্যায়ভাবে হত্যার বিষয়টিকে তিনি মেনে নেবেন না।’ ‘নিরাপরাধ কোনো ব্যক্তিকে হত্যার ক্ষেত্রে কেউ যদি অন্তত একটু মুখের কথায়ও তার প্রতিকার না করে থাকে, তবে কেয়ামতের দিনে তার কপালে লেখা থাকবে যে, ঐ ব্যক্তি মহান আল্লাহর করুণা হতে বঞ্চিত।’ ‘কোনো বান্দা যদি এমন অবস্থায় আল্লাহর কাছে উপস্থিত হয় যে, সে কারো রক্ত নিয়ে খেলেনি, তাহলে আল্লাহপাকের দায়িত্ব হয়ে যায় তাকে ক্ষমার চাদরে ঢেকে নেয়া।’ মহান আল্লাহ ও তদীয় রাসুলের উপরিউক্ত বাণীসমূহ একদিকে যেমন কঠোর সতর্কবার্তা অন্যদিকে আবার মানুষের জন্য প্রণোদনা; কিন্তু এসবের মূল লক্ষ্য হলো, সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখা।

এখানে আরেকটি বিষয় প্রনিধানযোগ্য যে, মহানবি মোহাম্মদ (সা.) ইসলামের প্রচার করেছেন যে মহাগ্রন্থের আলোকে তার নাম আল কোরআন; যাকে মহান আল্লাহ ‘সুস্পষ্ট কিতাব’ বলে অভিহিত করেছেন (সুরা মায়েদা, আয়াত-১৫)। এটি মহামহিমের অপার বিস্ময়, অতীব সম্মানিত কোরআন, (সুরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত-২৩) সংরক্ষিত এক ফলকে যা সুরক্ষিত, (সুরা বুরুজ, আয়াত-২২) যাতে সামান্যতম কোনো সংশয় বা ভুলও নেই, (সুরা বাকারা, আয়াত-২) পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা সংযোজনেরও কোনো অবকাশ নেই এবং এটি সেই কিতাব, যাকে আঁকড়ে থাকলে কখনোই কাউকে বিভ্রান্তির অনল স্পর্শ করবে না, পথভ্রষ্টতার অতলেও কখনো নিমজ্জিত হবে না- সেই মহাগ্রন্থ এসেছে মহামহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে (সুরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত-৮০)। এটি কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট জাতি, দেশ বা সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য আসেনি, এটি এসেছে সমগ্র বিশ্বমানবতার জন্য পথ-প্রদর্শনের জন্য (সুরা আল ইমরান, আয়াত-৯৬)। ‘হুদাল্লিন্নাস’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৫) বা সমগ্র মানবজাতির হেদায়েতের জন্য এই কিতাব, ‘হাযা বায়ানুল্লিন্নাস’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত-১৩৮) সমস্ত মানুষের জন্য এই কিতাবের বিশদ বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে, ‘তিবয়ানাল্লিকুল্লি শাইয়িন’ (সুরা আন্ নাহল, আয়াত-৮৯) সৃষ্টিজগতের সকল কিছুর বিবরণ এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

সুতরাং ইসলামের এই মহান মর্যাদাপূর্ণ গ্রন্থ নিয়েও কোনো সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয় নেই, বরং এ মহাগ্রন্থের রয়েছে সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য ও বিশ্বজনীন দিক-নির্দেশনা। সুতরাং এ দিক থেকেও ইসলাম স্বয়ং-সম্পূর্ণ। আর সে কারণেই বিদায় হজ্বের অভিভাষণে মহানবি (সা.) বিশ্বমানবতার জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ উপদেশাবলি মেনে চলার নির্দেশনা প্রদান করলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামের পরিপূর্ণতার বৈশিষ্ট্য সম্বলিত আয়াতে কারিমা অবতীর্ণ হয়ে যায়; যাতে বলা হয়, ‘আল য়াওমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নিমাতি ওয়ারাদিতু লাকুমুল ইসলামা দিনান’ অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জীবন-ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের উপর প্রবর্তিত নেয়ামতসমূহকেও সম্পূর্ণ করলাম আর ইসলামকেই তোমাদের জীবন-বিধান হিসেবে সাব্যস্ত করে দিলাম (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩)। তাই সেদিন থেকে ইসলাম হচ্ছে শান্তি ও সম্প্রীতির এক বিশ্বজনীন জীবন-বিধান হিসেবে স্বীকৃত।

লেখক: ডঃ মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ।