ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বাঙালির আগ্রহের কমতি নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া কেমন চলছে, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক চর্চা কেমন হচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রাম হচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয় বাঙালি সবসময় জানতে উদ্গ্রীব থাকে।

এর কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাদের আবেগ-ভালোবাসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে কেবল এর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাবেক শিক্ষার্থীরাই ভালোবাসে তা নয়, সমগ্র জাতিরই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আবেগ রয়েছে ঐতিহাসিক কারণেই।

কেননা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা-চেতনার গভীরে শেকড় সঞ্চার করেই বিকশিত হয়েছে আমাদের জাতিসত্তা ও স্বাধিকার চেতনা। সেই ঐতিহ্য আজও বর্তমান। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এখন বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা হচ্ছে।

শিক্ষার মান নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, কিছু শিক্ষকের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এসব সমালোচনার সবই যে সত্য তা নয়, তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অনেকের কাছে তীর্থভূমির মতো, সেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সমালোচনা হওয়াটাই বেদনাদায়ক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে বলে অনেকে বলে থাকেন। আমি বরং উল্টো কথা বলব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান দিনকে দিন আরও উন্নত হচ্ছে।

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় তার বিভিন্ন বিভাগের শিক্রাক্রমে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, যুক্ত করেছে নতুন নতুন বিষয়, এমনকি শিক্ষণ পদ্ধতিতেও নিয়ে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন।

ডিজিটালাইজড ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমসহ আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োগ করা হচ্ছে। যুগের চাহিদার কথা বিবেচনা করে খোলা হয়েছে অনেক নতুন নতুন ডিপার্টমেন্ট। তবে এতে যে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে না তা নয়।

যেমন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। এতে দিন দিন সংকুচিত হয়ে পড়ছে এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। আগের মতো ফাঁকা জায়গা আর নেই। যে হারে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে সেই হারে আবাসিক হল, লাইব্রেরিসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে না।

ফলে শিক্ষা কার্যক্রম যে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষেত্রে জায়গার পরিমাণ বাড়াতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার পূর্বাচলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কিছু জমি বরাদ্দ করেছে দ্বিতীয় ক্যাম্পাস করার জন্য। সুষ্ঠু শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য আরও জমি প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন অবকাঠামোগত উন্নয়নের জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অধিক সংখ্যক মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষসহ পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণের সরবরাহ।

একটা চিন্তার বিষয় হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কিছু বিভাগ আছে যেগুলোর ঐতিহ্যিক ও গবেষণাগত মূল্য অনেক হলেও বর্তমান যুগে পেশাগত মূল্য তেমন একটা না থাকলেও ক্রমাগত সেসব বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এসব বিভাগ থেকে ছাত্রছাত্রীরা পাস করে দীর্ঘকাল বেকার থাকে অথবা ছোটখাটো চাকরি করে যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য লজ্জার। অনেক শিক্ষার্থীই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হতে পেরেছি’ এই স্বস্তিটুকু পাওয়ার জন্যই এসব বিভাগে ভর্তি হয়।

আমার মনে হয়, এসব বিভাগে আসন সংখ্যা কমিয়ে এনে বরং গবেষণার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করে দেখতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ওপর আরেকটি অভিঘাত হিসেবে এসেছে ঢাকা শহরের সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা।

এমনিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল, অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে, উপরন্তু বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর এই সাতটি কলেজের তদারকির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রচুর সময় ব্যয় হচ্ছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তাছাড়া এই সাতটি কলেজের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে সময় ব্যয় হচ্ছে তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এতে সেশনজট সমস্যা সৃষ্টিরও আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। এই সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট পাবে যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামের জন্য সুখকর নয়।

এই সাতটি কলেজের দায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত হওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেয়া উচিত। না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে ইতিমধ্যে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তা বড় আকার ধারণ করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করা র‌্যাংকিং দিয়ে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কেননা এ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাঙালি জাতির চেতনার উৎসভূমি। তবে বিশ্বায়নের এই যুগে র‌্যাংকিংকে অস্বীকার করারও উপায় নেই।

কিছুদিন আগে টাইমস হায়ার এডুকেশন নামের একটি সংস্থা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকা, এমনকি এশিয়ার সেরা চারশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় নাম না থাকার কারণে চারদিকে সমালোচনার ঝড় সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই র‌্যাংকিংয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি। কেননা র‌্যাংকিংয়ে স্থান পেতে হলে নিজ গরজে তথ্য ও উপাত্ত পাঠাতে হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ করেনি। এটি অবশ্য র‌্যাংকিং করা প্রতিষ্ঠানগুলোরও সীমাবদ্ধতা।

অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে র‌্যাংকিং করা এই প্রতিষ্ঠানগুলোর র‌্যাংকিংয়ের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে আমার মনে হয়, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা ও বিশ্বায়নের কথা মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিযোগিতা করতে হয়।

যদি র‌্যাংকিংয়ে পিছিয়ে থাকি তবে সেটা হবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এক ধরনের অবিচার। আশার কথা, ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইসিটি সেলের মাধ্যমে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আগামী র‌্যাংকিংগুলোতে এ বিশ্ববিদ্যালয় যে অনেক সামনের সারিতে থাকবে তা এখন আশা করা যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাঙালি জাতির বিবেক বলে বিবেচনা করা হয়। তাদেরকে জ্ঞানের সমগ্রতাকে ধারণের মাধ্যমে কেবল পাঠ্যক্রমের উপস্থাপক ও নির্দেশকই নন, দার্শনিক সিদ্ধান্তের প্রস্তাবক হিসেবে, আদর্শিক গুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

এর কারণ কিছু শিক্ষক তাদের মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছেন, প্রাধান্য দিচ্ছেন বৈষয়িক চিন্তাকে, যা কাম্য নয়। জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যখন আর্থিক দুর্নীতি, যৌন হয়রানি, অশোভন আচরণ, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি, পঠন-পাঠনের চেয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও অর্থের পেছনে ছোটার মানসিকতা, পদ-পদবির জন্য আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দেয়াসহ নানাবিধ অভিযোগের তীর যখন ছোড়া হয়, তখন ভীষণ বিব্রতবোধ করি।

তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষক মেধার মূল্যায়ন না করে নিজের পছন্দের কাউকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগে যখন জোর খাটান কিংবা মেধাবী ছাত্রের সামান্য খুঁতকে বড় করে দেখে অথবা মিথ্যা অভিযোগে বাদ দেন তা খুবই দুঃখজনক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য শিক্ষকদের এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। তবে এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা মেলে অনেক আদর্শিক গুরু যাদের দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। অন্যরাও এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করবেন বলে আশা করি।

অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে থাকেন। এর কারণ রাজনীতিকে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিকীকরণ। ছাত্ররা যখন রাজনৈতিক আদর্শকে ছাপিয়ে ব্যক্তিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, তখনই ছাত্ররাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই অপকর্মের যাত্রা শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান।

ছাত্রদের আদর্শভিত্তিক রাজনীতি তথা দেশপ্রেম ও রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তে টাকার প্রতি লোলুপ করে তোলা হয়েছিল সেই সময়, যার প্রভাব এখনও বিদ্যমান। ছাত্রদের আদর্শের রাজনীতির ধারায় ফিরে যেতে হবে। বিএনপি আমলে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ ছিল, এখন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। আমিও ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম।

তো সেই ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ ওঠে তা আমাকে বেদনাতুর করে। ছাত্রলীগকে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য চেষ্টা করতে হবে। দীর্ঘদিন পর ডাকসু নির্বাচন হয়েছে।

নির্বাচিত ডাকসু নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির ধারা বজায় রাখতে সচেষ্ট হবেন এটা প্রত্যাশা করি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও উচিত হবে এ বিষয়ে শক্তভাবে লাগাম ধরা। কোনোমতেই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কলুষিত না হয়, সেদিকটি খেয়াল রাখা বাঞ্ছনীয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে গুণগত মানের আরও উন্নয়ন সাধনের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যে খুব কষ্টকর, তা কিন্তু নয়। প্রয়োজন কেবল সমন্বিত ও কার্যকর প্রয়াস। এই বিশ্ববিদ্যালয় দুই বছর পর শতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছে, এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঐতিহ্যিক ধারায় ফিরিয়ে আনা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে তুলে ধরেছেন। ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে দেশকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করা গেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবেন।

লেখক: বাহালুল মজনুন চুন্নু
সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।