বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নলালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করুণ হাল!

ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে ২০১১ প্রতিষ্ঠিত হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি)। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন দক্ষিণবঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। তিনি ১৯৭৩ সালে বরিশালের তৎকালীন বেলসপার্কের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু উদ্যান) এক সমাবেশে ঘোষণা দেন ঢাকার বাইরে যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তা হবে বরিশালে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে একদল ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলে ধূলিসাৎ হয়ে যায় সে স্বপ্নের।

পরবর্তীতে নানা চড়াই-উৎরায় পাড়ি দিয়ে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরের কর্ণকাঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন তিনি পূরণ করেন। মাত্র চারশ শিক্ষার্থী ও ছয়টি বিভাগ নিয়ে চালু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ এগিয়েছে অনেকদূর। বর্তমানে প্রায় সাত হাজার শিক্ষার্থী ও ২৪টি বিভাগ রয়েছে। শিক্ষার্থী-বিভাগ সংখ্যা বাড়লেও সময়ের চাহিদায় কতটুকু এগিয়েছে দক্ষিণবঙ্গের উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠটি প্রশ্ন থেকে যায়।

হাজারো সমস্যায় জর্জরিত বিশ্ববিদ্যালয়টি যেন প্রদীপের আলোর ন্যায় নিবু নিবু জ্বলছে। যেন কোন কিছুই ঠিক নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। দীর্ঘ দুই মাস আছে অভিভাবকহীন। টানা ৩৫ দিন ছাত্র আন্দোলনের মুখে ৪৫ দিনের স্বেচ্ছাছুটিতে যান সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এস এম ইমামুল হক। ছুটি কাটিয়ে গত ২৭ মে অবসরে যান বির্তকিত এই উপাচার্য। সেই থেকে শূন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক এই পদটি। ট্রেজারার ড. এ কে এম মাহবুব হাসান উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করলেও অস্থিরতা রয়েছে প্রশাসনিক কার্যক্রমে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই শূন্য উপ-উপাচার্যের পদটি। রেজিস্ট্রার পদেও রয়েছে নানাবিধ বির্তক। ফলে প্রশাসনিক-একাডেমিক কাজে চলছে অস্থিরতা।

প্রায় নয় বছরে পা দেওয়া দক্ষিণবঙ্গের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যাপক রয়েছেন ২ জন। অন্যদিকে ছয়টি অনুষদের বিপরীতে ডিনও ২ জন। এঁদের মধ্যেও একজন ছাত্র আন্দোলনের পর থেকেই ছুটিতে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। শিক্ষক সংকটও রয়েছে চরম মাত্রায়। প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন ১৮০ জনের। ফলে এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষা-কার্যক্রমে। সাত-আট মাস সেশন জটের কারণে শিক্ষার্থীদের সোনালি সময়টাকে হতাশায় কাটাচ্ছেন।

এদিকে একাডেমিক ভবন না বাড়িয়ে বছর বছর বিভাগ সংখ্যা বৃদ্ধি করার ফলে শুরু থেকেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শ্রেণিকক্ষ সমস্যা। সাত-আটটি ব্যাচের জন্য বরাদ্দ রয়েছে একটি মাত্র ক্লাসরুম। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ক্লাস করার জন্য। এমনকি ক্যাফেটেরিয়া ভবন এবং লাইব্রেরীতেও ক্লাস করতে হয় শিক্ষার্থীদের। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।

বৃষ্টির দিনে বঙ্গবন্ধু চত্তর, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ও আশে পাশের রাস্তাগুলোর জলাবদ্ধতা নিয়মিত চিত্র। নেই কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ভবনে নির্মাণে ত্রুটি থাকার কারণে ক্লাস রুমেও কখনো কখনো পানি জমে থাকে। বিষয়টা জানা থাকার পরও কোন পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের।

শিক্ষার্থীরা মজা করে বলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় হলো মরুভূমিময় ক্যাম্পাস। আর বলবেই বা না কেন? যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই শুধু ধু ধু বালু কণাই দেখা যায়। বড় কোন গাছপালা নেই ক্যাম্পাসে। কিছু গাছপালা লাগালেও অযত্ন, অবহেলায় তা আর বেড়ে উঠতে পারছে না। কোথাও বসে একটু গল্প-আড্ডা দেবার জায়গাও নেই। তীব্র রোদে যেমন খা খা করতে থাকে, তেমনি একটু বাতাসেও চোখে বালির ঝাপটা লাগে। এদিকে জুন-জুলাই মাস যাচ্ছে ক্যাম্পাসে বৃক্ষরোপণে প্রশাসনের কোন ভ্রূক্ষেপ এখন পর্যন্ত লক্ষ করা যায়নি। উপায়ন্তর না দেখে শিক্ষার্থীরায় স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে বেশ কিছু বৃক্ষ রোপণ করেছে।

আবাসন ও পরিবহন সংকটও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। প্রায় ৭ হাজার শিক্ষার্থীর বিপরীতে হল রয়েছে তিনটি। তিন হলে শিক্ষার্থী ধারণ ক্ষমতা ১৮০০ জনের। এক রুমে যেখানে চারজন থাকার কথা সেখানে শিক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে ৮ জন করে থাকে। হল ক্যান্টিনে খাবার মান নিয়েও শিক্ষার্থীদের রয়েছে নানাবিধ অভিযোগ। এদিকে আবাসিক হল সংকটের কারণে সিংহ ভাগ শিক্ষার্থীই শহরের বিভিন্ন জায়গায় হোস্টেল বা মেসে থেকে পড়া লেখা করে। তাঁদের যাতাযাতের জন্য পরিবহন সংকটও রয়েছে। বিআরটিসির লক্করজক্কর বাস নিয়ে অভিযোগ কমতি নেই শিক্ষার্থীদের।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গবেষণা কার্যক্রমেও রয়েছে একধরণের স্থবিরতা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৫৭ লাখ টাকা যা মোট বাজেটের ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গবেষণা খাতে এত কম বাজেটের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে চরম হতাশা। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে বইয়ের সংখ্যাও নগণ্য। ডিপার্টমেন্টের সেমিনারগুলোতেও বইয়ের সংখ্যা নেই বললেও চলে। ফলে বেশির ভাই শিক্ষার্থীকে শিট নির্ভর হতে দেখা যায়। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে ই-লাইব্রেরী সেবা চালু থাকলেও দক্ষ জনবলের অভাবে শিক্ষার্থীরা তার সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

তবে আশার কথা হচ্ছে এত সমস্যার মধ্যে থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও চাকরির বাজারে সাফল্য ছিনিয়ে আনছে। শিক্ষার্থীরা আকাশে ড্রোন উড়াচ্ছে, স্টুডেন্ট টু স্ট্রাট আপে সেরা দশে স্থান করে নিয়েছে, বির্তকে বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিজয় লাভ করছে। অ্যাথলেটিক্সে ভালো করছে। গত এসআই নিয়োগ পরীক্ষায় ১৮জন সুপারিশকৃত হয়েছে। ৩৯তম বিসিএসে ৪ জন ভাইবার জন্য সুপারিশকৃত হয়েছে। বিভিন্ন স্কলারশিপ নিয়ে জার্মান, চীন, ভারতে রয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থী।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে হলে অচিরেই এই সমস্যাগুলোর উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। নইলে যে বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন লালিত এই বিশ্ববিদ্যালয় অচিরেই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এ বিষয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর মিয়া দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছুদিন অভিভাবকহীন থাকার পরে মাননীয় ট্রেজারার স্যারকে মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর স্যারের রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এজন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু একজন পূর্ণকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর বিহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই গুরুপূর্ণ এসব বিষয় স্থবির হয়ে পড়েছে। তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির নিকট বিনীত নিবেদন দ্রুত একজন পূর্ণকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কর্মকাণ্ড তরান্বিত করতে সহায়তা করবেন। একই সাথে উপাচার্য স্যারের ছুটিকালীন সময়ে প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিষয়ে যেন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য একজন উপ-উপাচার্য নিয়োগেরও বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই।

‘তিনি আশা ব্যক্ত করেন, অচিরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব সমস্যা সমাধানের মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।