শিক্ষক রাজনীতি

সাদা সাদা ‘আরো সাদা’...নীল নীল ‘বাড়তি নীল’

‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি, কনফার্ম’ সেলফোনে শতরূপার কাছ থেকে এরকম খুশির সংবাদ পাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক, সুন্দর এবং প্রত্যাশিত। কিন্তু শতরূপার জন্য উল্টো আমি কষ্ট পেয়েছি। কারণ ‘চাকরিটা ওর হয়নি, সত্যিই’। কষ্ট পেয়েছি এ জন্য নয় যে, ও আমার পরিচিত; কষ্ট পেয়েছি কারণ বরাবরই তুখোড় রেজাল্ট করা, নৃবিজ্ঞানে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া এবং কেমব্রিজ থেকে এমফিলে গর্ব করার মতো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর লেকচারারশিপ হয়নি। আমি যেহেতু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি, তাই কেবল কষ্ট নয়, লজ্জাও পেয়েছি। চাকরিটা ওর কাছে নেহাত চাকরির জন্য দরকার ছিল না। অনেক বছর ওকে জানি, ওর একটা কমিটমেন্ট ছিল গবেষণা করবে, পড়বে, পড়াবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ওর কাছে আর দশটা পেশার মতো ঠিক চাকরি নয়; ও বলত, এই প্রফেশনটা হচ্ছে ‘এন্ড-ইন-ইটসেল্ফ’।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমার দেখা নৃবিজ্ঞানের অন্যতম সেরা এই মেধাবী মুখটি, গেলো বিএনপির সময়, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন নিয়োগ পেল না? কোনো রাজনৈতিক দলে নাম লেখাতে রাজি হয়নি বলে? ওর নামের শেষে ‘বড়–য়া’ পদটি আছে, এই জন্যে? কারণ কি এই যে ও খুব স্বাধীনচেতা, সব বিষয়ে ওর নিজস্ব মতামত থাকে? অনুগত-বাধ্যগত কিংবা বৌদ্ধমূর্তির মতো, শিক্ষকদের হাই-ডেফিনিশনে, যথেষ্ট শান্ত-সৌম্য-ধ্যানস্থ নয় বলে?

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চেয়ে ভালো রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও অনেক মেধাবী তরুণের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি হয়নি। ওই সময় চাকরি না হওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী জাহিদুর রহমান যে কষ্ট-লেখা এঁকেছিলেন তা পড়লে যে-কারো কান্না পাবে, ‘বাবা-মার খুব আশা ছিল ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। আমারও যে ছিল না, তা নয়। আর প্রথম টিউটোরিয়াল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত প্রথম হওয়া ছেলেকে নিয়ে বাবা-মা আশা করতেই পারেন। তারা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তাদের হয়নি। তাই এই প্রতিষ্ঠানের ক্লেদাক্ত রূপ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। ধারণা ছিল না এখানে কী পরিমাণে নোংরা রাজনীতির চর্চা হয়’। কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স ও মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েও জাহিদের ওই সময় স্থান হয়নি নিয়োগপ্রাপ্ত ছয় শিক্ষক পদের একটিতেও। জাহিদ প্রশ্ন করেছে, ‘এ দুর্ভাগ্য কি আমার? না কি জাতির? নাকি এ লজ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ের? আমার বিপরীতে যাদের নেওয়া হয়েছে, তাদের কারো কি একটিতেও প্রথম শ্রেণী আছে?’

বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন শতরূপা, জাহিদ, ফারুক, বিপ্লব কুমারের মতো আরো অনেক মেধাবীর চাকরি পেতে এতো সমস্যা হয়, তার জবাব আছে জাহিদের বিভাগীয় সভাপতির গোপন টেলিফোন কথোপকথনে, যা পরে ‘শিক্ষক নিয়োগে ক্যাসেট কেলেঙ্কারি’র খবর হিসেবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জাহিদ সম্পর্কে ওর সভাপতি বলেছে, ‘ও আমাদের লোক নয়, ওর কোনোদিনই হবে না’।

শিক্ষক নিয়োগে গেলো বিএনপির সেই সময়ের কিছু নমুনা তুলে দিচ্ছি: ‘শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ পদের বিপরীতে ২৬ জনকে নিয়োগ, ২৩ জনই জামায়াতের’; ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগে ৮৪টি পদে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে ৬৪ জনকে বিভিন্ন বিভাগে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হয়...এদের মধ্যে একসময়ের চিহ্নিত শিবির ক্যাডারও রয়েছে। বাকিদের বেশির ভাগই জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের পুত্র-কন্যা কিংবা ঘনিষ্ঠজন’; ‘ছাত্রদলের চাপে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ফরম বিক্রি বন্ধ, আগের নিয়োগ বাতিলের দাবি; ‘উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত দুর্নীতি...৪৩ জন শিক্ষক নিয়োগ...মেধা ও যোগ্যতা নয়, দলীয় পরিচয়ই এই নিয়োগের ভিত্তি’; ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-চিকিৎসক-কর্মচারী নিয়োগে বেপরোয়া দুর্নীতি ও দলীয়করণ’; ‘ঢাবিতে অর্ধশত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে...দলীয় রাজনীতির দাপটে দিন দিন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে ঢাবি পরিবার’ ইত্যাদি। এগুলো গেলো বিএনপির আমলের বয়ান।

আর এখন দিন আওয়ামী লীগের, বিভিন্ন সময়ের খবরের কাগজ ব্রাউজ করে দেখেছি, দেশের প্রায় সব ক’টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে পুরনো তামাশারই পুনরাবৃত্তি চলছে। এনিয়ে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো রিপোর্ট বিভিন্ন কাগজে বেরিয়েছে। খবরগুলো নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। আর কেবল বিএনপি বা আওয়ামী লীগ দিয়ে এসব ঘটনা ব্যাখ্যা করা যাবে না। বেশ ক’বছর ধরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগের চর্চাটি বেশ ভালোভাবেই চলছে। আওয়ামী শাসনামলে ছাত্রলীগের কর্মীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের নিয়োগ পেয়েছে, আর বিএনপির সময়ে ছাত্রদল-শিবিরের। এমন দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে যে বোর্ডে ফার্স্ট হওয়া অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী পাওয়া প্রার্থীকে স্রেফ রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানের সঙ্গে তফাত হচ্ছে, আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় লটধরে একসঙ্গে এত শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা হয়তো ঘটেনি। নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ হয়েছে আত্মীয়তা বা আঞ্চলিকতার মতো গ্রাম্য প্রপঞ্চও। এখন এমনও হচ্ছে, দলীয় শিক্ষকগণই বিভিন্ন বিভাগের সিলেকশন কমিটির সদস্য হচ্ছেন। মেধা ও যোগ্যতাকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক মতানুসারীদের নিয়োগের মাধ্যমে দল ভারীর এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রটি যে একসময় মেধাশূন্য হয়ে পড়বে, কেউ কি ভাবছে এ কথা?

তবে খেয়ালে রাখা দরকার, আমরা যখন বলি গত দু-তিন দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিম্নগামী হয়েছে, এদের তৈরি করা গ্র্যাজুয়েটদের মান ঠিক আশানুরূপ নয়, তখন এর মানে কিন্তু এই নয় যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে। বরং জ্যামিতিক হারে গলি-ঘুপচিতে বেড়ে ওঠা উচ্চ ফলনশীল এসব ‘প্রাইভেটে’ উল্টো চিত্রই দেখা যায়; কয়েকটিতে উপাচার্য নেই, কয়েকটি চলছে ‘প্রস্তাবিত’ উপাচার্য দিয়ে, প্রায় সবগুলো চলছে ধার করা শিক্ষক দিয়ে, আছে সকাল-বিকেল কিংবা আধবেলার শিক্ষক; অবকাঠামোর অবস্থা দুর্বল আর শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত দেয় বিনিয়োগকারী মালিকপক্ষ। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে, ‘চালু অবস্থায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় কিনতে চাই’। হা! ঈশ্বর, বিশ্ববিদ্যালয় কি দোকান না ফ্যাক্টারি যে চালু অবস্থায় কেনা-বেচা হবে?! উপাচার্য বা শিক্ষক নিয়োগে এখানেও কাজ করে আত্মীয়তা, রাজনৈতিক আদর্শ বা ব্যক্তিগত কানেকশন। মূলত ব্যবসার দিকে চোখ রেখে বাজারচলতি কিছু বিষয় পড়ানোর জন্যই দেশে ‘প্রাইভেট’ স্থাপনের হিড়িক লেগেছে। অধ্যাপক মোজাফফর যেমন বলেছেন, ‘আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে, আর এখন হয় ব্যবসার জন্য’। কথাটি খেয়ালে রাখার মতো অবশ্যই। তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন কত? এর উত্তরে মঞ্জুরি কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এখন সত্তর, দিনপাঁচেক পরে এসে আবার জিজ্ঞেস করলে দেখবেন আরো তিনটি বেড়ে গেছে’!

আমার বিবেচনায়, শিক্ষক নিয়োগের অনিয়মই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করছে। শিক্ষক-রাজনীতির নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ভোটের রাজনীতি চলে, শিক্ষকরা তাই শিক্ষক নন, তারা পরিণত হন একেকজন ভোটারের পটেনশিয়াল ভোটারে; তখন তাদের মেধা-যোগ্যতা গৌণ হয়ে যায়; ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতো তারাও হেডকাউন্টিংয়ের শিকার হন। লক্ষযোগ্য যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতো বাড়ি বাড়ি বা দলবদ্ধভাবে ভোট চাওয়ার গ্রাম্য কালচারটি দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীদের নির্বাচনেও ঘটছে। ভাবতে কেমন লাগে না যে, একজন অধ্যাপক ভোটভিক্ষা মাগতে একজন লেকচারারের বাসার পাঁচতলার সিঁড়ি ভাঙছেন! ভাবতে যেমনই লাগুক, ঘটনা কিন্তু এই-ই ঘটে। শিক্ষকরা যেহেতু ভোটার, তাই প্রত্যেক প্রশাসনই চায় নিজ দলের ভোটার বাড়াতে। মেধা-যোগ্যতার থোড়াই কেয়ার করে আওয়ামী প্রশাসন চায় তাদের আর বিএনপি প্রশাসন চায় তাদের মতাদর্শের কাউকে নিয়োগ দিতে; এতে দলীয় ভোট বাড়ে, এটাই নিট লাভ। সমীকরণটা খুব সহজ, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যখন আওয়ামী লীগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তখন আওয়ামী হয়ে যায়; মেধা-যোগ্যতা নির্বিশেষে আওয়ামী মতাদর্শের লোকরা তখন বেশি বেশি নিয়োগ পান। আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় এখন যেহেতু বিএনপি, সুতো মেপে ঠিক তাই এর উল্টোটি করা হচ্ছে।

শিক্ষক পদে একজন দলীয় লোক নিয়োগের অর্থ ৩৫/৪০ বছর ধরে একটি জঞ্জালকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বয়ে বেড়ানো। এমন শিক্ষকের কথাও আমাদের কানে আসে, যারা গত পাঁচ বছরে একটি ক্লাসও নেননি; নেননি মানে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়ানোর কনফিডেন্সই তার নেই। এদের নিয়োগই যেহেতু রাজনৈতিক, আত্মস্বার্থে এ ধরনের শিক্ষকরা পড়াশোনা বা ক্লাস নেওয়ার বদলে দলীয় রাজনীতির পেছনে বড় সময় ব্যয় করেন। এদের নিয়োগের সময় এক ধরনের বোঝাপড়া হয় এবং বোঝাপড়া থেকে যে অবলিগেশন তৈরি হয় তার প্রতি সম্মান দেখাতে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ও গোষ্ঠী-আধিপত্য বাড়ানোর কাজে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। কেননা পদোন্নতিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেতে তার রাজনৈতিক পরিচয়ই মূল ভূমিকা রাখে। এর পরোক্ষ প্রতিক্রিয়ায় যোগ্য শিক্ষকগণের একাংশও বাধ্য হন রাজনীতির পেছনে সময় ব্যয় করতে। এর ফলে শিক্ষকদের মধ্যে নতুন একটি শ্রেণী তৈরি হচ্ছে; আমার বিশ্লেষণ বলে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর ধরে ছাত্র-ক্যাডারের মতো নতুন শ্রেণী হিসেবে শিক্ষক-ক্যাডার তৈরি হচ্ছে। দলীয় রাজনীতির ওপর ভিত্তিশীল শিক্ষক-রাজনীতি আর ছাত্ররাজনীতি আজ ফানাফিল্লায় ভেঙে গিয়ে বাকাবিল্লায় স্থির হচ্ছে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা, ফলাফল কিংবা একাডেমিক প্রাপ্তিও প্রভাবিত হচ্ছে ‘বেনিআসহকলা’র বর্ণপ্রভাবে। যোগ্যতার রঙ যাচ্ছে ফিকে হয়ে। বর্ণরাজনীতির ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে বর্ণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এই-ই যদি চলে, তাহলে নিশ্চিত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ একসময় এসব শিক্ষক-ক্যাডারের হাতেই চলে যাবে। ঠিক যেমন ছাত্ররাজনীতি চলে গেছে ছাত্র-ক্যাডারদের হাতে।

অথচ জাতির প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে সমাজের সব থেকে প্রাগ্রসর অংশ জ্ঞান, চেতনা ও মুক্তবুদ্ধির মানুষ। কিন্তু আমরা কি তেমন মানুষ? আমাদের চিন্তা ও চেতনায় কি এক ধরনের বন্দিত্ব কাজ করছে না? সমাজের অন্যসব গোষ্ঠীর মতো শিক্ষকরাও তো সংকীর্ণ রাজনীতি চর্চায় জড়িয়ে পড়ছেন। ফলে মুক্তচিন্তাকে পাশে ঠেলে শিক্ষকরাও কোনো একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে নিজেদের আটকে ফেলছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বশাসনের মেজাজটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি শিক্ষকদের আকর্ষণ যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে জ্ঞানচর্চায় তাদের আগ্রহ যাচ্ছে কমে। রাষ্ট্রক্ষমতার অংশভাগ যেহেতু দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তাই দেখা যায়, শিক্ষক রাজনীতির নামে এখানে যা হয় মোটাদাগে তা আসলে দলবাজি। এই দলবাজির জন্য এক দল শিক্ষক মুক্তচিন্তা, বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন কিংবা সৃজনশীলতার চর্চা সব খুঁইয়ে ফেলতেও রাজি। দলবাজির লোভে শিক্ষকদের এক দল নির্দ্বিধায় নিজেদের বেচে দিচ্ছেন, বেচে দিচ্ছেন রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে কিছু পাওয়ার আশায়। বলতে দ্বিধা নেই, জাতীয় রাজনীতির গতিধর্মের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নির্লজ্জভাবে অন্তর্লীন হয়ে গেছে। চলমান ধারার শিক্ষক-রাজনীতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার স্বতন্ত্র ও স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। জাতীয় রাজনীতির নগ্ন থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে রাজনীতি থেকে শ’হাত দূরে থাকা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও।

শিক্ষকরা আজ চিহ্নিত হচ্ছেন ব্লু, হোয়াইট বা পিঙ্ক টিচার হিসেবে; কেউ কেউ এমন সাদা হচ্ছেন যে বাড়তি নীলের প্রয়োজনই থাকছে না; দ্বন্দ্ব কেবল সাদা-নীলে নয়, দ্বন্দ্ব চলছে নীল-সাদার ভেতরেও সাদা আর দুধ-সাদায় কিংবা নীল, ফিকে-নীল আর গাঢ়-নীলে। নিয়োগ নিয়ে শরিক বিএনপি-জামায়াতের মধ্যেও চলে টানাপড়েন; কোথাও ভাগ হচ্ছেন উপাচার্যপন্থি আর উপাচার্যবিরোধী একেকজন লড়াকু শিক্ষক হিসেবে; আবার কোথাও, বিপন্ন বিস্ময়ে দেখি, শিক্ষকরা ভাগ হচ্ছেন রবীন্দ্র বা নজরুল গ্রুপে; কিন্তু কেউ জীবনানন্দ হচ্ছেন না, রাজনীতিকে এক পাশে ফেলে যিনি সৃজনশীলতার চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন আমৃত্যু। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকগণ আজ আর কোনো পূর্ণ মানুষ নন, কেবলই ‘ভাগের মানুষ’।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমনবিধ পরিস্থিতি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে উপাচার্যসহ বিভিন্ন পদের বণ্টন হয় রাষ্ট্রক্ষমতা তথা দলীয় রাজনীতির সঙ্গে নৈকট্যের ভিত্তিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান পদকে সবসময় ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে। দুঃখজনকভাবে শিক্ষকরাও ক্ষমতাসীন অথবা ক্ষমতামুখীদের আধিপত্য বিস্তারের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছেন। অথচ কাগজে-কলমে দাবি করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন আছে। বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুসারে। যে উদ্দেশ্যে’ ৭৩-এর অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছিল, সেই লক্ষ্যকে মিথ্যে প্রমাণ করে দেখি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছানুযায়ী। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অতি তুচ্ছ বিষয়ের সিদ্ধান্তও আসে রাষ্ট্রের ওপর মহল থেকে। স্বায়ত্তশাসনের অর্থ তাহলে কোথায় থাকে? কেবল বইয়ে? ক্যালেন্ডার ওয়ান, টু আর থ্রি তে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকেন, যা নবক্ষই দশকের সূচনা লগ্ন থেকে দলবাজিতে পরিণত হয়। তারা এখন বেশ ভালোভাবেই গোষ্ঠীস্বার্থে লেপ্টে গেছেন এবং লেপ্টে আছেন। সবার উপলব্ধি বেশ শক্তভাবেই হয়েছে যে দলীয় রাজনীতির উলঙ্গপনা ঢুকে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মগজে, কোনো রাখঢাকের বালাই না রেখেই। প্রতিনিয়ত দলীয় রাজনীতির যূপকাষ্ঠে মেধার বলি হচ্ছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো জ্ঞানকে সংরক্ষণ করে, সৃজন করে এবং তা বিতরণের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করা; সত্যের সন্ধান করা এবং লব্ধ সত্যের জনসংযোগ ঘটানো। জাতি প্রত্যাশা করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সৃজনশীল বিজ্ঞানমনস্ক অসাম্প্রদায়িক আর মুক্তচিন্তার আধুনিক মানুষ তৈরি করবে। ‘সর্বজনীন চিত্তের উদ্দীপন, উদবোধন, চারিত্রসৃষ্টি এবং পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের যে আদর্শ’ তা আজ হয়তো পুরোটা সম্ভব নয়, যেমনটি সম্ভব হয়েছিল রাজা শীলভদ্রের পক্ষে, যিনি রাজ্য ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিলেন বিদ্যার প্রতি গৌরববোধের কারণে, শ্রদ্ধায়। এই সাত্ত্বিক আদর্শ আজ সেকেলে ঠেকলেও জ্ঞানার্জনের মৌল উদ্দেশ্য কিন্তু তা-ই। ভুলে গেলে ভুল হবে যে, সারি সারি দালানরাশি জেলখানারও থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়েরও থাকে; একটি বন্দি করে, অপরটি করে মুক্ত। তবে আসল কিন্তু এ বাড়িঘর নয়, আসল বাড়িঘরের ভেতরকার মানুষগুলোর মিথস্ক্রিয়া।

রোবায়েত ফেরদৌস
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
robaet.ferdous@gmail.com

নোট: লেখক এই কলামটি লিখেছিলেন ২০১২ সালে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির বিশেষ ত্রৈমাসিক সংখ্যায় এটি প্রকাশিত হয়েছিল।