প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে বিজয়ী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়!

ব্রিটেনে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং সেই সুবাদে ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে বিজয়ী কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানই- অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটেনের অভিজাত শাসক গোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। এটি কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়।

ব্রিটেনে স্যার উইনস্টন চার্চিলের সময় থেকে এ পর্যন্ত যে ১২ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তাদের মধ্যে নয়জনই অক্সফোর্ডের গ্রাজুয়েট। এদের সবাই পড়েছেন অক্সফোর্ডে। সেকারণেই কি ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন?

সব হিসেব ঠিক থাকলে বরিস জনসনেরই ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি পড়েছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এখনো যিনি টিকে আছেন, সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টও অক্সফোর্ডের গ্রাজুয়েট।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য কনজারভেটিভ পার্টিতে শেষ যে চারজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছিল, তাদের তিনজনও ছিলেন অক্সফোর্ডের ছাত্র। শুরুতে যে ১১ জন প্রার্থী হয়েছিলেন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার জন্য, তাদের মধ্যেও ৮ জন অক্সফোর্ডে পড়েছেন। পাঁচ জন তো ছিলেন একই বিষয়ের ছাত্র।

ব্রিটেনের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে অক্সফোর্ডে পড়েছেন। তার স্বামীও সেখানকার ছাত্র। আর তাদের দুজনের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অক্সফোর্ডেরই আরেক ছাত্রী বেনজির ভুট্টো। যিনি পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।

অক্সফোর্ড ইউনিয়ন ডিবের্টিং সোসাইটি: সত্তরের দশকে বেনজির ভুট্টো ছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিয়ন ডিবেটিং সোসাইটির প্রধান। এটি ব্রিটেনের সবচেয়ে বিখ্যাত ডিবেটিং সোসাইটিগুলোর একটি। ব্রিটিশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিখ্যাত লোকজনের পদচারণা এই ক্লাবে। যারা রাজনীতিতে বড় কিছু হওয়ার উচ্চাভিলাষ রাখেন, এই ক্লাবে যোগ দেয়া তাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য বলে বিবেচনা করা হয়।

অক্সফোর্ড ডিবেটিং ক্লাবের যাত্রা শুরু ১৮২৩ সালে। বহু বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক
এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন।

থেরেসা মে-ও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন না। তার জায়গায় এখন যারা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য লড়ছেন, তাদের ক্ষেত্রেও তাই। ব্রিটিশ রাজনীতিতে শ্রেণী, বৈষম্য এবং রাজনীতি বিষয়ে গবেষণা করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিওফ্রে ইভান্স। তার মতে অক্সফোর্ডের এত গুরুত্ব আসলে একটি কারণে, এটি আসলে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক তৈরির এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা।

অক্সফোর্ড ডিবেটিং ক্লাবের যাত্রা শুরু ১৮২৩ সালে। বহু বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক এই ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ‘যদি আপনি অক্সফোর্ডে পড়াশোনার সুযোগ পান এবং ডিবেটিং ক্লাবে নিজের সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে কিন্তু আপনি এমন সব মানুষের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন, যা আপনাকে রাজনীতিতে ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ করে দেবে।’

দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি : ১৯২০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ফিলজফি, পলিটিক্স এন্ড ইকনোমিক্স (পিপিই) নামে একটি কোর্স চালু করে। এই কোর্সটি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়কদের কাছে। গত একশ বছরে অক্সফোর্ডের এই পিপিই কোর্স যারা করেছেন তাদের মধ্যে আছেন-

তিনজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী (এডওয়ার্ড হীথ, হ্যারল্ড উইলসন এবং ডেভিড ক্যামেরন)

তিনজন অস্ট্রেলিয়ান প্রধানমন্ত্রী (টনি অ্যাবট, ম্যালকম ফ্রেজার এবং বব হক)

পাকিস্তানের চারজন প্রধানমন্ত্রী এবং একজন প্রেসিডেন্ট (লিয়াকত আলী খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, বেনজির ভুট্টো, ইমরান খান এবং ফারুক লেঘারি)।

ঘানার দুজন প্রেসিডেন্ট (কফি আব্রেফা বুসিয়া এবং জন কুফোর)

থাইল্যান্ডের দুজন প্রধানমন্ত্রী (কুক্রিট প্রামোজ এবং অভিষিট ভেজাজিভা)

পেরুর একজন প্রধানমন্ত্রী (পেড্রো পাবলো কুসজিনস্কি)

এবং মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর (আং সান সুচী)

তবে এরা হচ্ছেন অক্সফোর্ডের বিখ্যাত গ্রাজুয়েটদের গুটিকয় মাত্র, যারা একেবারে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী পাকিস্তানি মালালা ইউসুফজাই এখন অক্সফোর্ডে এই একই বিষয়েই পড়াশোনা করছেন।

সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণী: ব্রিটেনে এবং অন্যান্য দেশে অভিজাত শাসকশ্রেণীর মধ্যে অক্সফোর্ডের গ্রাজুয়েটদের এই যে প্রাধান্য, এর শুরু কিন্তু অনেক আগে। ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার শীর্ষে, যেখানে আপনাকে ঢুকতেই দেয়া হবে না - যদি আপনি সঠিক পটভূমি থেকে না আসেন বা আপনার যদি ভালো যোগাযোগ না থাকে’, বলছেন অধ্যাপক ইভান্স।

তার মতে, অক্সফোর্ডে কারা যেতে পারবেন আর কারা পারবেন না, সেই বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় অনেক আগে, একেবারে অল্প বয়স থেকেই। শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু ব্রিটেনে আবার এটাও সত্য, এখানে যে নামী-দামী প্রাইভেট স্কুলগুলো আছে, সেখান থেকে প্রচুর ভালো রেজাল্ট করা ছেলে-মেয়ে বের হয়। এই স্কুলগুলোতে পড়ার খরচ খুবই বেশি।

এই বৈষম্য বা অসাম্য ঠিক করার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যাতে করে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের ছেলে-মেয়েরা অত ভালো রেজাল্ট না করেও যেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে।

এর ফলে যেটা হচ্ছে, যারা অভিজাত পরিবার থেকে আসে না, যাদের সঠিক যোগাযোগ নেই বা আর্থিক সঙ্গতি নেই, তাদের জন্য রাজনীতিতে সফল হওয়া খুব কঠিন। ব্রিটেনে যে ধরণের নির্বাচনী ব্যবস্থা, সেখানে বিদ্যমান কাঠামোর বাইরে থেকে এসে কারও পক্ষে নতুন একটি দল তৈরি করা এবং পার্লামেন্টে যথেষ্ট আসন জেতা কঠিন।

এর মানে হচ্ছে, রাজনৈতিক আকাঙ্খা আছে এমন যে কাউকে প্রতিষ্ঠিত দুটি দলের একটিতে যোগ দিয়ে সুবিধাভোগী অভিজাতদের বিরুদ্ধেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। এভাবে সফল হওয়া একেবারে যে অসম্ভব তা নয়। যেমন ধরা যাক মার্গারেট থ্যাচার বা টেরিজা মে'র কথা। তারা দুজনই সাধারণ পরিবার থেকে এসেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার শীর্ষে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

ব্রিটেনে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হওয়ার লড়াইয়ে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেননি এমন গুটিকয় প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন ছিলেন সাজিদ জাভিদ। তিনি একজন অভিবাসী বাস ড্রাইভারের ছেলে। তবে কনজারভেটিভ পার্টিতে তার উত্থানও সহজ ছিল না। আগে তাকে ব্যাংকিং ক্যারিয়ারে সফল হয়ে অভিজাত শ্রেণীর কাতারে উঠে আসতে হয়েছে। তারপরই তিনি কনজারভেটিভ পার্টির সামনের কাতারে জায়গা পেয়েছেন।

এটা বাস্তব যে ব্রিটেনের অভিজাত শাসক শ্রেণীর মধ্যে আসলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অবস্থার প্রতিফলন নেই। তবে এটাও সত্য, যারা শেষ পর্যন্ত শীর্ষ সারিতে পৌঁছাতে পেরেছেন তারা সবাই শিক্ষায়-দীক্ষায় এগিয়ে।

এই যে শাসক শ্রেণীর মধ্যে একই ধরণের পটভূমি থেকে আসা লোকজনের এত প্রাধান্য, সেটা সমাজের জন্য ভালো না খারাপ - তা বিচার করার কোন সুনির্দিষ্ট উপায় নেই। তবে যেটা প্রায় নিশ্চিত, তা হলো একজন অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েটই হয়তো ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। খবর: বিবিসি বাংলা।