নিঝুম দ্বীপের গল্প

প্রতিকী

ঈদের পর তখন সবাই ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। বন্ধুরা মিলে আমাদের একটা ছোটখাটো গ্রুপের মতো আছে। প্রতিবছর ঈদের পর একটা টার্গেট থাকে নতুন কোন জায়গায় ক্যাম্প করার। কারণ সবাই তখন বাড়ীতে একসাথে হয়। গতবছর করেছিলাম কক্সবাজার। তাই এ বছর অনেক গবেষণার পর বের হলো নিঝুম দ্বীপেই হবে আমাদের ক্যাম্প।

নিঝুম দ্বীপ যাবার ব্যাপারটা এত ঝামেলার, এটা আগে জানতাম না। তারপরে ও খুব চিন্তাভাবনা করে প্ল্যান করা হলো। মোটামুটি ৯ জনের একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেলো। তাবু ম্যানেজ করা হলো ১ টা। প্ল্যান হলো জুনের ১০ তারিখ যাবো। সুতরাং সেই মত তাঁবুর সব জিনিসপত্র, কোথায় থাকা হবে- এগুলো একটা মোটামুটি প্ল্যান হয়ে গেলো। এরপর খালি যাবার অপেক্ষা।

 

নিঝুম দ্বীপ হলো মেঘনা নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা বিশাল চর এলাকা। আমরা হলাম নোয়াখালীর একদম উত্তর পাশ্বে। তাই এখান থেকে নিঝুম দ্বীপ যাবার সবচাইতে শর্টকাট রুটটা হলো নোয়াখালী চেয়ারম্যানঘাট হয়ে যাওয়া। সকাল ৮ টার লঞ্চে ধরে যাবার কথা। কিন্তু বাস ঘাটে যেতে দেরি হওয়ায়, আমরা সেখানে ৯ টায় গিয়ে পৌছঁলাম। পরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ট্রলারে করে হাতিয়া নলচিড়া ঘাটে যাওয়ার জন্য রওনা হলাম।

এতো মানুষ যে যায় হাতিয়া, আমাদের ধারণা ছিলো না। ট্রলারে তিলধারণের জায়গা নেই। আমরা কোনমতে একটা বসার জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমাদের সাথে ট্রলার চালকের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো। তিনি আমাদেরকে গাইডলাইন দিচ্ছিলো কোথায় কি করতে হবে। কথা বলতে বলতে হাতিয়া নলচিড়া ঘাটে চলে আসলাম। গিয়ে দেখি বেশ অবাক করা ব্যাপার। এত মানুষ যে হাতিয়াতে বসবাস করে এটা আগে জানতাম না।

এবার যেতে হবে হাতিয়ার মোটামুটি শেষ মাথায় নিঝুম দ্বীপের ঘাটে, অর্থাৎ মোক্তারঘাট সেখান থেকে ছোট ট্রলারে নিঝুম দ্বীপ। অনেক কষ্টে মোক্তারঘাটে গিয়ে পৌঁছলাম। কারণ রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। নিঝুম দ্বীপের ঘাটে পৌঁছানোর পরপরই বেশ খিদে লেগে গিয়েছিলো সবার। ভারী নাস্তা করে নিলাম সবাই, সাথে গরুর দুধের চা। এগুলো হলো ট্রিপের স্পেশাল পাওনা, কেউ মনেহয় দু’কাপের কম খাইনি! যাই হোক, নিঝুম দ্বীপ যেতে যেতে তখন প্রায় দুপুর ৩ টা বাজে।

ঘাটে নেমেই আমরা সবাই মোটরসাইকেলে উঠে গেলাম। এবার গন্তব্য নিঝুম দ্বীপের আরেক প্রান্তে, ওখানেই সবার থাকার ব্যবস্থা। ‘নিঝুম রিসোর্ট’ বেশ সুন্দর। সামনে একটা ছোটখাটো মাঠমতোন আছে। বারবিকিউ, ক্যাম্পফায়ার সবই মোটামুটি করা যায়। সেখানে এক রুমের একটা বাসা নিলাম যাতে তিনটা বেড ছিলো। আমরা তো আসলে তাঁবুতেই থাকবো। তবুও অনেক বড় গ্রুপ, তাই সেফটি হিসেবে এটা করা হয়েছিলো।

সেখানে আমরা আলতাফ চাচার হোটেলে দুপুরের খাবার শেষ করলাম। আমরা দ্বীপ ঘুরতে বের হয়ে গেলাম। ওখান থেকে খুব কাছেই বিচ এরিয়া। কিন্তু আমরা সেইটা জানতাম না। আমাদের পুরো বিকেলটা দ্বীপেই কেটেছে। পরে সন্ধ্যায় খবর পেয়ে আমরা বিচে গেলাম। বিশাল সীবিচ- সূর্য ডুবছে, আমরা ছাড়া আর তেমন কোন ট্যুরিস্ট গ্রুপও নাই। প্ল্যান হলো রাতে এখানেই ক্যাম্প হবে। আমরা বেশ ছবি তুলছি। আর ক্যাম্পের জায়গাটা ফিক্সড করে হোটেলে চলে এলাম। সবাই বেশ টায়ার্ড। সবাই হাল্কা রেস্ট নিয়ে নিলাম, নাহলে রাতে মজা হবে না। হোটেলটার রান্না বেশ ভালো। সবাই আরেকদফা ভারী খাওয়া-দাওয়া করে নিলাম। এখন আমরা সেই চরে চলে যাবো। কিন্তু কারো পা যেনো চলছেই না। যেখানে বসে তো বসেই থাকে! রাত দেড়টার দিকে মনে হয় সবাই ক্যাম্পসাইটে গিয়েছিলাম।

এবার কাজ টেন্ট পিচ করা। পূর্ণিমা ছিলো ভালোই। এসব কাজে ওস্তাদ কিছু লোকজন আমাদের গ্রুপেই ছিলো। কিন্তু কি যে বাতাস! টেন্টগুলো পিচ করার পর মনে হচ্ছিলো ভেসে যাবে। আমরা ব্যাকপ্যাক দিয়ে টেন্টগুলো সব সাপোর্ট দিয়ে দিলাম। এর পরের কাজ আগুন জ্বালানো, ক্যাম্পফায়ার না হলে কি হয়? কেরোসিন আছে, সাথে ছেলেপুলে খুঁজে কাঠ নিয়ে আসলো এবার দাও আগুন! কি আছে জীবনে?

মোটামুটি সব ট্যুরেই আমাদের সাথে ফানুস থাকে, এখন ফানুস ওড়াতে হবে। কিন্তু কি যে বাতাস! ফানুসগুলো উপরের দিকে ওড়ার কোন প্রেশারই পাচ্ছে না, কেমন ডিগবাজি খেয়ে সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে। ওড়ার বদলে ফানুসের ডিগবাজি খেতে দেখাটা একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা বটে!

তখন রাত প্রায় ১২ টা বাজে। চরে নেমে   পড়লাম সবাই। তখন পূর্ণিমা না হলেও কিন্তু চাঁদের আলো বেশ ছিলো। আমরা বনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বিশাল চর, এমাথা-ওমাথা পুরো দেখা যায় না! এটা মূলত সোয়াম্প ফরেস্ট। বর্ষায় ডুবে থাকবে, শীতে চর। প্রায় ২০ মিনিটের মত হাঁটার পর আমরা বনের শুরুর পয়েন্টে পৌঁছে গিয়েছি। জায়গাটা অতিমাত্রায় নির্জন। ১০ বা ২০ মাইলের মধ্যে কেউ আছে কিনা জানিনা আমরা। বনের ভেতরে ঢুকেই আমরা একটা ছোট পুকুরের মতোন দেখলাম।

এটাই হরিণের পানি খাবার জায়গা তাহলে! সুতরাং এখানেই ক্যাম্প করতে হবে। এ অংশটা বনের একদম বাইরের দিকে। এরপর একদম ঘন হয়ে গিয়েছে বনটা। এখানে ক্যাম্প করার দু’টো সুবিধা- প্রথমত, বাতাস আমাদের অ্যাটাক করার সুযোগ নেই; আর আশেপাশে জ্বালানি কাঠের অফুরন্ত ভান্ডার। আগের রাতে চরে ক্যাম্প করতে গিয়ে শিমুল আর জুয়েল এক মহিলার বাড়ি লুট করেছিলো খুব সম্ভবত! পরে রাত ৩ টার দিকে ২ মাইল দূর থেকে উনার চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছিলাম আমরা। এখানে নো টেনশন! আস্ত বন এখানে, সুতরাং টেন্টের পেগ গাড়ো! ৩ টা টেন্ট ট্রায়াঙ্গল শেপে রেখে মুখগুলো পুকুরের দিকে করে দিলাম আমরা। ভুলে হরিণ যদি দেখা যায় এক-দু’টা! মাঝে আমাদের ক্যাম্পফায়ার।

যেহেতু পুরো রাত এখন আমাদের, প্রচুর জ্বালানি কাঠ আনা হলো। দাও আগুন, কি আছে জীবনে! আগুন জ্বলছে। আমরা গোল হয়ে বসে আছি! এগুলো হলো যেমন খুশি তেমন করো টাইপ সময়। যার যা খুশি করতে পারে। ৯ জন সদস্য- একেকজন একেকটা করছে। সুভ দারুণ সব অ্যাঙ্গেলে ছবি ট্রাই করছে। এসব জায়গায় রাসেদ কেনো জানি চুপ মেরে যায়, আর আমার কাজ হলো বকবক করা। নাইলে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

সবাইকে গিয়ার আপ করাটা একটা বড় কাজ বটে! এসব কাজে চান্দুকে সবসময় পাই আমি। জুয়েলের প্রধান কাজ ছিলো টেন্ট পিচের সময় টর্চ ধরে রাখা, এর থেকে বেশি সে কি করতে পারে এটা আমাদের জানা নেই। শিমুল আমাদের কাজগুলো দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে, ও মনে হয় বেশি মজা পাচ্ছিলো। এটা আরেকটা রাজ্যই বটে! হঠাৎ দেখি সুভ শিবের মত তান্ডবনৃত্য শুরু করেছে! পুরো ওয়াইল্ড ড্যান্স। সাথে আরো কে কে ছিলো মনে নেই! সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলছে। উৎসবের আয়োজন সম্পন্ন, সুতরাং এখন ফানুস ওড়াতে হবে!

আমি যামিনী, তুমি শশী হে…

এখানে বাতাসের তান্ডব নেই। ফানুস উড়িয়ে দিলাম। আহা কি সুন্দর উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা বিচের দিকে যাবার বদলে বনের দিকে উড়ে গেলো। ফানুসের আগুন কোথাও পড়ে বনে আগুন লেগে গেলে শেষে জেলে ঢুকতে হবে! যাই হোক, এটা উড়ে কই গেছে জানার সৌভাগ্য হয়নি। রাত ২ টার দিকে আমাদের অখন্ড অবসর। চিন্তা করলাম বনের বাইরের দিকে যাই। বের হয়ে বিশাল চর। মাঝে মাঝে গাছের সারি। কি যে অসাধারণ লাগছিলো জায়গাটা! এখানেই ক্যাম্প করা দরকার ছিলো আসলে। আমরা সবাই এক গাছের সারির নিচে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। আহা কি শান্তি!

কি সুনসান এ জায়গা, শত কোলাহল থেকে অনেক মাইল যেনো দূরে। অনেক দূরে সমুদ্র আবছা দেখা যাচ্ছে। আমরা তখন আজগুবি সব আলাপে! এত পরিষ্কার আকাশ অনেকবছর দেখি না! রাতের এ সময়টা আকাশ মনে হয় আরো সুন্দর লাগে। শিমুল এর মধ্যে নেট অন করে কোনটা কোন তারা এসব নিয়ে গবেষণা করছে- সপ্তর্ষিমন্ডল, জুপিটার, মার্স, আরো কি কি সব দেখলাম। আমরা শুয়ে আছি আর ভাবছি তারাগুলো কত দূরে, এখানে আলো আসতে আসতে হয়তো তারাটা আর জীবিত নেই, একই সাথে অতীত এবং বর্তমান! আপেক্ষিকতার মূল রহস্যটাতো এখানেই!

রাত তখন ৪ টা বাজে। কারোরই ওঠার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু টেন্টে ঢুকতে হবে! পরদিন সকালে রওনা। এখন না ঘুমালে সকাল ১০টার আগে কেউ পারবে না উঠতে। পরদিন খুব ভোরে উঠে গেলাম আমরা ৬ টার দিকে, হরিণ যদি আসে! কিন্তু হরিণ মনে হয় বেশ ভীতু টাইপ প্রাণী, রাতে আগুন দেখে হয়তো ভাবছে বনে দাবানল লেগেছে। ওদের টিকিটিরও দেখা পেলাম না আমরা! কি আর করা, টেন্ট সব গুছিয়ে আমরা রওনা দিয়ে দিলাম বিচের দিকে। একটা জিনিস মিস করে গিয়েছি। আগের রাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছিলো আমরা বড় ট্রলারে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ থেকে নোয়াখালি চেয়ারম্যানঘাট চলে যাবো- ওটাতে সবচাইতে আরামে যাওয়া যাবে।

শেষদিন ভোরে…

আমরা ছোট ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে বসেছি, ওটা যথারীতি দুলছে এদিক সেদিক। হঠাৎ বড় ট্রলারের শব্দ। দূর থেকে সিন্দাবাদের জাহাজের মতোন লাগছিলো ওটাকে। মনে হচ্ছিলো আমরা যেনো দ্বীপে আটকেপড়া এক ট্যুরিস্ট গ্রুপ উদ্ধার পাবার আশায় বসে আছি! ডিঙ্গি থেকে ওটাতে উঠতে কত যে কাহিনী! যাই হোক, শেষকালে উঠে গেলাম কোনমতে! আমাদের সাথে রাতে তেমন কোন খাবার ছিলো না। সকাল থেকে ক্ষুধায় কাতর (স্পেশালি আমি)। ট্রলার চলছে, অনেকে ছাদে বসে আছে। প্রচন্ড রোদ, তাই আমরা একটু আড়াল পাবার জন্য ওটার একমাত্র কেবিন টাইপ জায়গাটাতে ঢুকে গেলাম। পোলাপানের আর কাজ কি? তাস পেটাও! ৪ ঘন্টা পর ১ টার দিকে চেয়ারম্যানঘাট পৌঁছে গেলাম আমরা।

ট্যুর প্রায় শেষ, এখন যে যার গন্তব্যে চলে যাবো আমরা

আমরা মোটামুটি ট্যুরের শেষ পর্যায়ে। এবার ক্রেডিট দেবার পালা। পুরো ট্যুরের কৃতিত্বটা আমি শিমুলকে দিবো। ট্যুরের বাকি সদস্যদের কথা কম বেশি বলেছি। শুভ কিন্তু দারুণ ছবি তুলে। এ ট্যুরের যত্ত সুন্দর ছবি- প্রায় সব ওরই তোলা। সোহেল সবচাইতে নিশ্চুপ টাইপ! তবে ট্যুরে সবাইকে কিছু করতে হবে- এরকম কোন রুলস নেই। তবে এ ট্যুরের আসল ট্যুইস্ট হলো আমি যে এ গল্পটা লিখছি।

আমি গল্পটা লেখার চেষ্টা করেছি এভাবে যেন অন্তত যারা এটা পড়বে, তারা যেনো মোটামুটি ভালো একটা ধারণা পায়। বিশাল গ্রুপে ট্যুর করার অসাধারণ মজা, খরচ যেমন কমে যায় তেমনি অনেককিছু অনুধাবন করা যায় খুব সহজে।