১০ লাখ মানুষের সেবায় নিউরোসার্জন মাত্র ১ জন!

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুয়েকজন নিউরোসার্জারি চিকিৎসক থাকলেও সেখানে চাহিদামতো ক্রানিউটমি, হাইস্পিড ড্রিল, অপারেটিং মাইকোস্কপি, এন্ডোস্কপি, নিউরো- নেভিগেটর ও নিউরো-ক্যাথল্যাব নেই
দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের সেবায় মাত্র একজন করে নিউরোসার্জন চিকিৎসক রয়েছেন। পাশাপাশি এক্ষেত্রে অবকাঠামো, লোকবল, যন্ত্রপাতি ও ওষুধ-পথ্যেরও ব্যাপক সংকট আছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অফ নিউরোসার্জন্স সদস্যদের (চিকিৎসক) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ১৬০ জন নিউরোসার্জন সেবা দিচ্ছেন। যা প্রতি এক মিলিয়ন (১০ লাখ) জনসংখ্যার অনুপাতে ১ জন। নিউরোসার্জনরা এও বলছেন, চাহিদার তুলনায় চিকিৎসক অপ্রতুল হলেও সেবা প্রদানে রোগীদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তারা। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, সহায়ক জনবলের অপ্রতুলতা, যন্ত্রপাতি ও ওষুধের সংকট সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে।

এ বিষয়ে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সাইন্স হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক বলেন, উন্নত বিশ্বে প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার জন্য ১ জন নিউরোসার্জন আছে। সে হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুপাতে দরকার ১ হাজার ৬০০ জন। এমনকি ন্যূনতম চাহিদায় প্রতি ৫ লাখ জনগণের জন্য একজন করে হলেও অন্তত ৩০০ জন প্রয়োজন। যদিও আগামী ৫ বছরে আরও ৮০-৯০ জন নিউরোসার্জন তৈরি হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করছেন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে আরটিএআই হেড ইনজুরির মতো রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। যাদের চিকিৎসায় ৬৪টি জেলায় ৩৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজ থাকলেও সেখানে নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে বেশির ভাগ রোগীর চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হয়। যা তাদের প্রাণহানি ও বিড়ম্বনার কারণ। মূলত নতুন মেডিকেল কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত পদ না থাকায় চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। মেডিকেল কলেজগুলোতে দ্রম্নত পদ সৃষ্টি করে পদায়ন করলে সেবার কলেবর বাড়বে। পাশাপাশি সর্বাধুনিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান অর্জনের জন্য এসব চিকিৎসকের সরকারি উদ্যোগে বিদেশে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ একজন নিউরোসার্জনকে জটিল অস্ত্রোপচার ছাড়াও শিক্ষার্থীদের পাঠদান ও প্রশিক্ষণ দিতে হয়।

চিকিৎসকরা আরও জানান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুয়েকজন নিউরোসার্জারি চিকিৎসক থাকলেও সেখানে চাহিদামতো ক্রানিউটমি, হাইস্পিড ড্রিল, অপারেটিং মাইকোস্কপি, এন্ডোস্কপি, নিউরো- নেভিগেটর ও নিউরো-ক্যাথল্যাব নেই। একে করে বিভিন্ন ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা পোস্টগ্রাজুয়েট তরুণ নিউরোসার্জনদের সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। অনেকেই নিউরোসার্জিক্যাল কেন্দ্র্রসমূহে পোস্টিং নিতে পারছেন না। ফলে নিউরো এনেশথেসিয়, নিউরোরেডিওলজি, নিউরোপ্যাথলজির মতো সহযোগী বিষয়গুলোতে উন্নত সেবা প্রদানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য যেসব মেডিকেল কলেজে নিউরোসার্জারি কোর্স চালু আছে সেখানে ছাত্র ভর্তি বৃদ্ধি ও পুরাতন ৮টি মেডিকেল কলেজে কোর্স চালু করা দরকার। নিউরোসার্জনদের উপযুক্ত পদায়নের মাধ্যমে দেশের সবখানে নিউরোসার্জারি সেবা প্রদানে পুরাতন ১৪টি মেডিকেল কলেজে নতুন পদ সৃষ্টি করা জরুরি। এ ছাড়া নিউরোসার্জারিতে বর্তমানে বিভিন্ন সাব স্পেশালিস্ট যেমন; স্কালবেজ, পেডিয়াট্রিক ভাস্কুলার, এন্ডোস্কপিক ও অনকোলজি ইউনিট ইত্যাদি শাখা চালু হচ্ছে। সেখানেও সরকারি পর্যায়ে ওই বিভাগসমূহ ও আলাদা পদ সৃষ্টি করতে হবে। তা ছাড়া নিউরোসার্জারি একটি বিশেষায়িত সেবা হওয়ায় পর্যাপ্ত জনবলের পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া এর অপারেশন, ইন্টারভেনশন সুচারুরূপে করা সম্ভব হয় না। তাই সুষ্ঠু কর্মসম্পাদনের লক্ষ্যে এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ বা পুনঃপ্রদান জরুরি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জারি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক বলেন, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালগুলোতে রেসিডেন্সি চিকিৎসকরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা কোর্স করতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ দেশের বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেন না। আবার দেশেও বিষেশজ্ঞ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা কম। ফলে চিকিৎসক বাড়লেও সবাই আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে অনেকটাই ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকারের উচিত বিষয়টির প্রতি নজর দেয়া।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সোসাইটি অব নিউরোসার্জনস-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার বলেন, বিগত কয়েক দশকে দেশে নিউরোসার্জারি বিষয়ক স্বাস্থসেবা প্রদান দ্রম্নত বিস্তার লাভ করছে। যদিও শিক্ষা, গবেষণা ও উন্নত সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে কিছুটা পিছিয়ে। এজন্য দেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে নিউরোসার্জারিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদসৃষ্টি, পদায়ন, কোর্স চালু ও চালুকৃত কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ওপর সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।