প্রতিষ্ঠানের অবহেলাতেই ঘটছে যৌন হয়রানির ঘটনা

৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টের আদেশ মানেনি

দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একের পর এক যৌন হয়রানি ও শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনা সামনে আসছে। এ ধরণের ঘটনা এড়াতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা মানেনি অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অনেকের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের অবহেলাতেই ঘটছে যৌন হয়রানির ঘটনা।

জানা গেছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও এখনো বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ স্কুল কলেজেই গঠন করা হয়নি যৌন হয়রানির অভিযোগকেন্দ্র। ২০০৯ সালে দেয়া রায়ের ১০ বছর পার হলেও এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি হাইকোর্টের সেই রায়।

শুধুমাত্র স্কুল-কলেজগুলোর ক্ষেত্রেই না, দেশের নামকরা সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্রও একই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই কোন যৌন হয়রানীর অভিযোগ কেন্দ্র। ফলে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যৌন হয়রানির ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পর্দার আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান সময়ে এতো অধিক সংখ্যক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটলেও এটা খুবই আশ্চর্যের যে, অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী জানে না- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগকেন্দ্র থাকার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তারা অভিযোগ করে বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠানে অভিযোগকেন্দ্র থাকলেও সেই কমিটিগুলোর কোন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। কমিটিগুলোর এমন নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে দিন দিন হয়রানির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগ করলেও কোন প্রতিকার পাচ্ছেনা।

সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীতে এক মাদ্রাসা ছাত্রী নিজ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা করার পর তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যু হয় নুসরাতের। ওই ঘটনার পর দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ফলে এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, স্কুল-মাদ্রাসায় অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীরা কতখানি নিরাপদ? অভিভাবক এবং কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে কতটা সচেতন।

কর্মকর্তারা বলেছেন, অধিকাংশ স্কুলে এ ধরণের কমিটি না থাকা সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। কারণ এতে ওই সব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌনি হয়রানির খবর সামনে আসছে না বা অজানাই থেকে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতা বিষয়ক সংস্থা- ইউএন ওমেন বাংলাদেশের কর্মসূচি বিশ্লেষক মাহতাবুল হাকিম বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যৌন হয়রানির ব্যাপারটিকে কর্তৃপক্ষ তেমন গুরুত্ব দেন না। এটি তারা খুবই হালকভাবে গ্রহণ করেন।’

ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মনে করেন, এ ধরণের ঘটনাগুলো জানাজানি হলে তা ভূক্তভোগীর জন্য লজ্জার কারণ হতে পারে। এমনকি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য সুনাম ক্ষুন্নের কারণ হতে পারে বলেও তাদের মত।

২০০৯ সালে হাইকোর্ট একটি আদেশ দেন, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে কমিটি করতে বলা হয়। এ কমিটি যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে কাজ করবে, বিষয়টি খতিয়ে দেখবে এবং এ ব্যাপারে করণীয় ঠিক করবে।

পরে ২০১০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরণের কমিটি গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তবে তাতে সংশ্লিষ্টরা সামান্যই কর্ণপাত করে।

ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে হত্যার ঘটনার পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিএসএইচই) গত ১৮ এপ্রিল এ ধরণের কমিটি গঠন করার জন্য আরও একটি নির্দেশনা জারি করে। ২০০৯ সালে হাইকোর্টের আদেশের আলোকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এছাড়া কমিটি গঠনের পর তা অবহিত করতে বলে ডিএসএইচই। এছাড়া নিজস্ব ওয়েবসাইটে কমিটির সদস্যদের নাম যুক্ত করতে বলা হয়।

ডিএসএইচই একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত মাত্র ৪০ শতাংশ স্কুল ও কলেজে যৌন হয়রানি অভিযোগ কমিটি পাওয়া গেছে। অথচ দেশে ৩০ হাজারের বেশি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা রয়েছে।

এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিএসএইচই) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ফারুক বলেন, ‘ঈদের পর এ ব্যাপারে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠানো হবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো মনিটরিংয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি করা হবে।’

এমন কমিটি করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, ৩৫টি সরকারি এবং ৫৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরণের কমিটি রয়েছে।

ইউএন ওমেনের ২০১৩ সালের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্তত ৭৬ শতাংশ ছাত্রী কোন না কোনভাবে যৌন হয়রানির শিকার। এছাড়া অ্যাকশন এইডের ৩০ শিক্ষার্থীকে নিয়ে করা জরিপ অনুযায়ী, তাদের ৮৪ শতাংশই নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির ব্যাপারে সতর্ক নন।

২০০৯ সালের নির্দেশ বাস্তবায়িত না হওয়ায় চলতি বছরের ৬ মে হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হাইকোর্ট বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে এ ধরণের কমিটি করতে অবহেলা দুর্ভাগ্যজনক।