রমজান কেন্দ্রিক সমাজে প্রচলিত ভুল-ভ্রান্তি

প্রতিকী

রমজান মুমিনের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস। হাদিসের গ্রন্থগুলোতে রহমত, মুক্তি ও গুনাহ মাফের পাশাপাশি আরও অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে রমজানকে কেন্দ্র করে। রাসূলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যখন রমজান মাস শুরু হয় তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়।” (বোখারী, মুসলিম, মুআত্তা, মালেক)।

মুমিনকে এই বিরাট ফজিলত থেকে বঞ্চিত করতে শয়তানের ষড়যন্ত্র আর নফসের মায়াজাল সদা তৎপর। এর সাথে যদি যুক্ত হয় অজ্ঞতা তাহলে তো আর কথাই নেই, পথভ্রষ্টতা ও গোমরাহি নিশ্চিত। ইসলামের সকল বিধিবিধানের মধ্যে ভুল-ভ্রান্তি আর কুসংস্কাররের যে ধারা চালু হয়েছে অজ্ঞতার প্রভাবে, রমজান তা থেকে বাঁচতে পারেনি। অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি সমাজে প্রচলিত হয়েছে রমজান কেন্দ্রিকও।

বিধানগতভাবে ভ্রান্তিগুলোর কিছু আকীদাগত, কিছু ফিকহি অপব্যাখ্যা আর কিছু রেওয়াজ রুসুমগত কুসংস্কার। ভুল-ভ্রান্তির মৌলিক বিষয়গুলো রমজান মাসের ফজিলত কেন্দ্রিক বক্তব্য ও বিভিন্ন রেওয়াজ বিষয়ক বিভ্রান্তি, রোজার ও তারাবিহর বিধি-বিধান কেন্দ্রিক বিভ্রান্তি, লাইলাতুল কদর কেন্দ্রিক বাড়াবাড়ি ইত্যাদি।

এসব ক্ষেত্রে ভুল-ভ্রান্তির পরিমান এত ব্যপক যে এর দলীল প্রমানসহ বিস্তারিত বিবরণের জন্য একটি বিরাট গ্রন্থের প্রয়োজন। তাই দলীল প্রমান ও তাত্ত্বিক আলোচনার পেছনে না পড়ে এখানে শুধু বিভ্রান্তির বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে।

রমজান মাস কেন্দ্রিক বিভ্রান্তি:

রমজানের ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। তা সত্ত্বেও অনেকে রমজানের ফজিলত প্রমাণে মিথ্যার আশ্রয় নেন, সমাজেও এ বিষয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে। তাছাড়া নানা ধরণের ভুল ধারণা ও আমল মাসব্যাপী চলছে বছরের পর বছর।

  • একটি কথা প্রচলিত আছে যে, মৃতের মৃত্যুর পরে জুম’আর দিন বা রমজান আসলে তাঁর কবরের আযাব চিরতরে মাফ হয়ে যায়। একথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও এধরণের বক্তব্য পাওয়া যায় না। অনেকে আহসানুর ফাতাওয়ার বরাত দিয়ে এটি প্রমান করতে চান, কিন্তু গ্রন্থটির দশম খন্ডে দলীল প্রমানের দ্বারা উক্তিটিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে (আহসানুল ফাতওয়া ১০/৪৩৩-৪৩৫)।
  • আরেকটি ভ্রান্ত কথা প্রচলিত আছে যে, রোজাদারের খাবারের কোন হিসাব নেই। এটিও ভ্রান্ত কথা। খাদ্যের হিসাব নিকাশের সাথে রমজান ও রোযার কোন সম্পর্ক নেই। হালাল খাবার সব সময়ই হালাল আর হারামও সর্বদা হারাম, অপচয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা।
  • যাকাত শুধু রমজান মাসেই দিতে হয় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন, এটিও একটি বিভ্রান্তি। যাকাতের সম্পর্ক বর্ষপূর্তির সাথে, রমজানের সাথে নয়।
  • রমজানের চাঁদ দেখায় সংশয় হলে অথবা রমজানকে স্বাগত জানাতে দু’একদিন আগে থেকেই রোজা শুরু করা একটি বিভ্রান্তি যার ব্যপারে হাদিসে নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
  • সেহরিতে ডাকার জন্য মাইকে দীর্ঘ সাইরেন বাজানো, ঢোল পিটনো, হইহুল্লোড় ইত্যাদি মানুষের কষ্টের কারণ বলে পরিত্যাজ্য। মসজিদের মাইক থেকে সেহরীর সময়ে তেলাওয়াত, গজল ইত্যাদি গ্রহণযোগ্য নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বরং বিদ’আত।
  • কাউকে সন্দেহ এড়ানো বা সতর্কতার জন্য ইফতার দেরিতে করতে দেখা যায়, এটিও একটি ভুল। রাসূলুল্লাহ (স) সেহরি দেরিতে ও ইফতার দ্রুত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

রোজা কেন্দ্রিক ফিকহি ভুল বোঝাবুঝিঃ

রোজা কেন্দ্রিক ফিকহি ভুল-ভ্রান্তি মূলত দুই ধরণের। ক. যা প্রকৃত পক্ষে রোজা ভঙ্গের কারণ কিন্তু লোকে তাকে রোজা ভঙ্গের কারণ মনে করে না ও খ. যা রোজা ভঙ্গের কারণ নয়, কিন্তু লোকে তাকে রোজা ভঙ্গের কারণ মনে করে।

ক. রোজা ভঙ্গের যেসব কারণ সম্পর্কে বিভ্রান্তি রয়েছে, কোনটি ব্যপকভাবে আর কোনটি কিছু মানুষের মধ্যে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যা রোজা ভঙ্গকারীঃ

  • কানে বা নাকে ওষুধ দিলে, তবে চোখে দিলে রোজা ভাঙ্গবে না।
  • কুলি করার সময় অনিচ্ছায় কণ্ঠনালীতে পানি চলে গেলে।
  • এমন কোন জিনিস খাওয়ার দ্বারা যা সাধারণত খাদ্য নয়। যেমনঃ মাটি, পাথর, কয়লা ইত্যাদি।
  • বিড়ি, সিগারেট বা সমজাতীয় দ্রব্য সেবনে।
  • রাত আছে মনে করে সুবেহ সাদিকের পর সেহরী খেলে অথবা সূর্যাস্থ হয়েছে মনে করে সূর্যাস্থের পূর্বে কিছু খেলে।
  • দাঁত থেকে প্রবাহিত থুথুর চেয়ে বেশি রক্ত কণ্ঠনালীতে চলে গেলে।
  • মুখে পান রাখা অবস্থায় ঘুমিয়ে গেলে যদি সুবেহ সাদিক হয়ে যায়।

খ. যা রোজা ভঙ্গের কারণ নয়, কিন্তু সমাজে রোজা ভঙ্গের কারণ বলে প্রচলিতঃ

  •  মেসওয়াক করা। যে কোন সময়ে হোক, কাঁচা হোক বা পাকা হোক। উপরন্তু মেসওয়াক করা সুন্নাত।
  • শরীরে, দাড়িতে বা পোশাকে তেল, সুগন্ধি, সুরমা, প্রসাধনী ব্যবহার করা ও তাঁর ঘ্রাণ নেয়া।
  • ভুলক্রমে পানাহার বা স্ত্রীসম্ভোগ করা, স্বপ্নদোষ হওয়া।
  • ইনজেকশন, টিকা বা স্যালাইন লাগালে।
  • শরীর থেকে ইঞ্জেকশনের সাহায্যে রক্ত বের করলে। এতে রোজা রাখার শক্তি চলে না গেলে মাকরুহও হয়না। (আহসানুল ফাতাওয়া, ৪র্থ খন্ড)
  • রান্নার সময় খাবার চেখে দেখা, তবে অবশ্যই তা কণ্ঠনালী পর্যন্ত পৌঁছা যাবে না।

তারাবিহ কেন্দ্রিক বিভ্রান্তিঃ

তারাবিহ কিয়ামুল লাইলের রাকা’আত সংখ্যা নিয়ে চলমান বিতর্ককে ব্যাখ্যা করার স্থান নয় এটি। তবে সংক্ষেপে ভুলটুকু আলোচনা করছি। বিশ রাকা’আত তারাবিহ সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমানিত এবং উম্মাহর অধিকাংশ ইমাম এ ব্যাপারে একমত। ইবনে তাইমিয়া (র) সহ কেউ কেউ তা আট রাকা’আত বলেছেন।

তবে তাঁরা কেউই বিশ রাকা’আতের বিরোধীতা করেননি। এই হিসেবে বলা যায়. বিশ রাকা’আতের বিরোধিতা না করার ব্যাপারে উম্মাহর ইজমা সংঘটিত হয়েছে। রাকা’আত কেন্দ্রিক বিতর্কের বাইরেও কিছু ভুলভ্রান্তি রয়েছে।

  •  খতম তারাবির ইমামের সাথে টাকার চুক্তি করা বৈধ নয়। হাদিয়া দেয়া যেতে পারে, বরং দেয়া উচিৎ, তবে তা অবশ্যই চুক্তিভিত্তিক হওয়া যাবে না। ইমামের হাদিয়ার জন্য প্রকাশ্যে চাঁদা উঠানোও একটি মারাত্মক ভুল। এর দ্বারা পুরো ইবাদতই ইখলাসশূণ্য ব্যবসায় পরিণত হয়।
  • খতমের নামে অতিদ্রুত কুরআন তেলাওয়াত একটি বিভ্রান্তি। এতে অধিকাংশ সময় অর্থেরও বিকৃতি ঘটে যা মারাত্মক গুনাহর কাজ। ধৈর্যের সাথে স্পষ্ট করে পড়তে না পারলে সুরা তারাবিহ পড়া উচিত। তবুও কোরআনকে তামাশার বস্তু বানানো থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
  • চার রাকা’আত পর পর যে বিরতি নেয়া হয় তা মূলত বিশ্রামের জন্য। এসময়ে প্রচলিত দোয়ার কোন ভিত্তি নেই। তবে এ বিরতিতে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হতে পারে।
  • আট রাকা’আত হোক বা বিশ রাকা’আত হোক ইমামের সাথে শেষ পর্যন্ত শরীক থাকা জরুরি। বিশ রাকা’আত পড়া ইমামের পেছনে আট রাকা’আত পড়ে উঠে যাওয়া এক ধরণের বিভ্রান্তি। এব্যপারে সকলেই একমত। এজন্য জামাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

লাইলাতুল কদর কেন্দ্রিক বিভ্রান্তিঃ

রমজানের একটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ রাত্রি হল লাইলাতুল কদর। তবে এ রাত্রি নির্দিষ্ট নয় বরং রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোর যে কেন একটি। এ রাত কেন্দ্রিক অনেক বিভ্রান্তি প্রচলিত রয়েছে। কিছু বিভ্রান্তি তুলে ধরছি-

  • কদরকে শুধুমাত্র ২৭ এর রাত্রিতে নির্দিষ্ট করা একটি ভ্রান্তি। অনেকে এ রাতকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তবে মূল কথা হল কদর কোন নির্দিষ্ট রাত নয় বরং শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে ঘুরে ঘুরে আসে।
  • এ রাতে গোসল করার ফজিলত সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বর্ণনা করে থাকেন, যার সবই বানোয়াট এবং বিভ্রান্তি। একটি যয়ীফ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রমজানের শেষ দশ রাতের প্রত্যেক রাতে রাসূলুল্লাহ (সা) মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে গোসল করতেন। (ইবনু রাজাব, লাতাইফ ২/৩০৯, ৩১৩-৩১৫)। তবে এর সাথে শবে কদরের যেমন কোন সম্পর্ক নেই, তেমনি এর কোন ফজিলতও বর্ণিত হয়নি।
  • এ রাতের সালাতের নিয়ত, নিয়ম, রাকা’আত সংখ্যা, বিশেষ সূরা ইত্যাদি যত কথা বলা হয় তার সবই ভিত্তিহীন। (আব্দুল হাই লখনবী, আল-আসার, ১১৫পৃ.) মূল কথা হল, অন্যান্য রাতের নফল নামাজের মতই এ রাতের নামাজ। এর কোন নির্দিষ্ট নিয়ত, নিয়ম, দোয়া কিছুই নেই।
  • এ রাত উপলক্ষে মসজিদে আলোকসজ্জা করা, হালুয়া রুটি, মিষ্টান্ন বিতরণ এ সবই বিদআত। আর সব নফল সালাতের মত এ রাতের সালাতও ঘরে একাকি পড়া উত্তম।

রমজান ও রোজা কেন্দ্রিক এ ধরণের অসংখ্য বিভ্রান্তি রয়েছে আমাদের সমাজে, যা অজ্ঞতা ও বিজ্ঞ আলেমগণের সাথে সম্পর্কহীনতার কারণ। আমাদের উচিৎ হবে ব্যক্তিগত পরিসরে সাধ্যমত গ্রন্থাদি অধ্যায়ণ করা এবং আমলকে সর্বদা বিজ্ঞ আলেমগণের পরামর্শ অনুসারে করা। আমাদের ইবাদতের পরিমাণ এমনিতেই নগণ্য, এগুলোও যদি বিভ্রান্তিমুক্ত না হয় তাহলে তা বড়ই শোচনীয়। মহান আল্লাহ আমাদের এসকল ভুল-ভ্রান্তি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন। আমীন।

লেখক: মোজাজ্জাজ আল মাদলাজী
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১০ম ব্যাচ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ