রাজশাহীতে আম বিক্রি শুরু

রাজশাহীর আম, সারাদেশেই যার পরিচিত। এমনকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও রাজশাহীর আমের জুড়ি নেই। রাজশাহীর আম বলতেই যেন অনেকের কাছে একটি লোভনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রাজশাহীর মানুষদের কাছেও এই আম নিয়ে নানা স্বপ্ন গেঁথে থাকে। এখানকার অর্থনীতির একটি বড় অংশ আমের উপর নির্ভর করে । জেলার পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর বাজারেই কেবল বছরে এই আমের বেচাকেনা হয় অন্তত দুই হাজার কোটি টাকার। ফলে বছরের এই সময়টা আমময় হয়ে ওঠে গোটা রাজশাহী।

জেলার বাঘা, চারঘাট, পুঠিয়া, দুর্গাপুর ও পবা এলাকায় সবচেয়ে বেশি আমের উৎপাদন হয়। এছাড়া বাকি চারটি উপজেলার মধ্যে গোদাগাড়ীতে বাণিজ্যিকভাবে বেশকিছু নতুন আমের বাগান গড়ে উঠেছে । এর বাইরেও জেলার মোহনপুর, তানোর ও বাগমারাতেও আমচাষ হয়। ফলে বছরের এই সময়টার দিকে তাকিয়ে থাকে গোটা জেলার মানুষ। সেই আম আজ বুধবার থেকে পাড়া শুরু হবে রাজশাহীতে। প্রশাসনের বেধে দেওয়া সময়ের আগে কেউ এবারো আম পাড়তে পারেননি । ফলে সাতটি ধাপে পর্যায়ক্রমে রাজশাহীতে আমপাড়া হবে।

পূর্বপুরুষের আমল থেকে গ্রামে এই সময়ে মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনকে আম-চিঁড়ির দাওয়াত করে খাওয়ানোর রেওয়াজ এখনো আছে। শহরে এই প্রচলনটা নেই বললেই চলে। কিন্তু গ্রামে আমের সময়কে কেন্দ্র করে বাড়িতে বাড়িতে যেন উৎসবে পরিণত হয়। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে এখন আলোচনার বিষয় বছরে কে কত টাকার আম বিক্রি করছেন। আম বিক্রির টাকায় চলে নানা হিসেব-নিকেশ। যারা প্রতি বছর বাণিজ্যিকভাবে আম বিক্রি করেন, সেসব পরিবারের কর্তারা আম নিয়ে বুনেন নানান স্বপ্ন। কে কোন খাতে আমবিক্রির টাকাটা খরচ করবেন, সেটি আগে থেকেও ঠিক করে রাখেন অনেকেই।

প্রশাসনের বেধে দেওয়া সময় অনুযায়ী রাজশাহীতে ১৫ মে (আজ) থেকে গুটি আমপাড়া যাবে। এরপর ২০ থেকে গোপালভোগ, ২৫ থেকে রানীপ্রসাদ ও লক্ষণভোগ, ২৮ মে থেকে হিমসাগর, ৬ জুন থেকে ল্যাংড়া, ১৬ জুন থেকে আম্রপালি ও ফজলি এবং আশিনা আম পাড়া যাবে পহেলা জুলাই থেকে।

জেলার বাঘা উপজেলার আম ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান বলেন, সরকারি নির্দেশনা মেনে আজ থেকে আমরা আম বাজারজাত শুরু করবো। গত বছরের চেয়ে এবার ৫দিন আগ থেকেই বাজারে আম আসতে শুরু করবে। গত ২০ মে থেকে বাজারে আম কেনা বেচার সময় বেধে দেওয়া হয়েছিল প্রশাসন থেকে। এবারো দেশের সবচেয়ে বড় আমের হাট বসছে পুঠিয়ার বানেশ্বরে। এই হাটে শুরুর দিনেই আসবে গুটিজাতের আম। পর্যাক্রমে আমের পরিপক্কতা অনুযায়ী আম বাজারে আসবে। আর আম কেনাবেচায় ভরে উঠবে বানেশ্বরের বাজার। ফলে ব্যবসায়ী ও আমচাষিরা এখন পুরোমদমে প্রস্তুত আমপাড়া নিয়ে।

আমকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য পাল্টে দিয়েছে এ অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতি। রাজশাহী অঞ্চলের দুটি বড় আমের মোকাম রাজশাহীর বানেশ্বর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজার মিলে প্রতিদিন বেচাকেনা হয় অন্তত দুই কোটি টাকার আম। আমের কারবার নিয়ে রাজশাহী অঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থানও হয়ে উঠে। গাছের আম নামানোর কামলা থেকে, আম পরিবহণ, আম চালানের ঝুড়ি বানানো এবং বাজারগুলোয় আম সংশ্লিষ্ট নানা কাজে এসব মানুষ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এমনকি রাজশাহীর কুরিয়ার সার্ভিসগুলোও আমকেন্দ্রীক ব্যস্তময় হয়ে উঠবে।

রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলাম জানান, প্রশাসনের বেধে দেওয়া সময়ের আগেই আমপাড়া হলে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত আছে। এরই মধ্যে জেলার বাঘা ও পুঠিয়ায় দুটি অভিযান চালিয়ে ৬ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একজনকে জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়াও আমে রাসায়নিক বা ফরমালিন মিশিয়ে কেউ যেন তা বাজারজাত করতে না পারে সে জন্যেও প্রস্তুত আছে পুলিশ।

রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বলেন, ‘আম সুষ্ঠভাবে বাজারজাত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এবারো শতভাগ ফরমালিনমুক্ত রাজশাহীর আম যেনো মানুষ খেতে পারেন তার জন্য সবচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি ভ্রাম্যমান আদালতও অভিযান চালাচ্ছে। ফলে এবারো কোনোভাবেই অপরিপক্ক ও ফরমালিনযুক্ত আম বাজারজাত করতে দেওয়া হবে না। রাজশাহীর আমের প্রতি দেশব্যাপী মানুষের যে আস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি পূর্ণরুপেই বাস্তবায়ন করা হবে।

এদিকে চলতি বছর রাজশাহীতে আমের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে। এখান থেকে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন। গত বছর রাজশাহীতে আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে। গত বছর আম উৎপদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন। তবে সেই রেকর্ড ভেঙে এবার সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হবে বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।