পা বেঁধে, মুখে কাপড় ঢুকিয়ে ৩ কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে কর্মকর্তারাই বন্দি কিশোরদের ওপর নির্যাচন চালিয়েছেন এবং বিনা চিকিৎসায় আহতদের ফেলে রাখায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নির্যাতনের মাত্রা এমন ছিল যে অচেতন অবস্থায় জ্ঞান ফেরা মাত্রই দফায় দফায় তাদের নির্যাতন করা হয়। বন্দি নির্যাতনে কর্মকর্তারা তাঁদের অনুগত কয়েক বন্দি কিশোরের সহযোগিতা নেন।

শনিবার দুপুরে যশোরের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন তাঁর সভাকক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে- এ ঘটনায় কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কসহ পাঁচ কর্মকর্তা জড়িত। যে কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। পুলিশ তাঁদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে।

আটককৃতরা হলেন- তত্ত্বাবধায় (সহকারী পরিচালক) আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহকারী তত্ত্বাবধায়ক (প্রবেশন অফিসার) মাসুম বিল্লাহ, কারিগরি প্রশিক্ষক (ওয়েল্ডিং) মো. ওমর ফারুক, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর এ কে এম শাহানুর আলম এবং সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর মুশফিকুর রহমান।

পুলিশ সুপার জানান, ১৩ আগস্ট দুপুরে কেন্দ্রের কর্মকর্তারা তাদের অনুগত ৭ কিশোরের মাধ্যমে বন্দিদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালায়। যার ফলে গুরুতর আহত তিন কিশোর বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।

পুলিশ সুপার বলেন, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড নূর ইসলাম বন্দি কিশোর হৃদয়কে তাঁর চুল কেটে দিতে বলেন। ঈদের আগে হৃদয় কেন্দ্রের প্রায় ২০০ শিশু-কিশোরের চুল কাটে। সেদিন সে হাতে ব্যথার কথা বলে চুল পরে কেটে দেওয়ার কথা জানালে হেড গার্ড বিষয়টি অতিরঞ্জিত আকারে সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহকে অবহিত করেন। ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদসহ অন্য কর্মকর্তারা সেখানে ছিলেন। নূর ইসলাম তাদের জানান, হৃদয় ও পাভেল নেশা করে অসংলগ্ন অবস্থায় রয়েছে। সে কারণে চুল কেটে দেয়নি; বরং তাকে গালিগালাজও করেছে। ওই সময় সেখানে নাঈম নামে এক বন্দি ছিল। নাঈম বিষয়টি পাভেলকে জানায়। এরপর পাভেল ও তার সহযোগীরা হেড গার্ড নূর ইসলামকে মারধর করে তাঁর একটি হাত ভেঙে দেয়।

তিনি আরো জানান, বৃহস্পতিবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জাতীয় শোক দিবস পালনের লক্ষ্যে একটি সভায় মিলিত হন। এই সভা শেষে উপস্থিত কর্মকর্তারা ৩ তারিখের ঘটনায় সম্পৃক্তদের শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে মারধরের ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও সাক্ষীদের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করে তাদের ডরমেটরিতে ডেকে পাঠান।

তিনি জানান, কেন্দ্রের কর্মকর্তারা সেখানে বন্দি তাদের অনুগত সাত কিশোরকে ব্যবহার করেন ১৮ জনকে মারধর করতে। তারা প্রত্যেক কিশোরকে ধরে জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে দুই হাত ঢুকিয়ে অপর পাশে আরেকজনকে দিয়ে হাত ধরায়, পা বাঁধে এবং মুখে কাপড় ঢুকিয়ে লাঠি ও লোহার পাইপ দিয়ে কোমর থেকে পা পর্যন্ত পেটায়।

কিশোরদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, কর্মকর্তারা তাদের নির্দেশ দেন- অচেতন না হওয়া পর্যন্ত পেটাতে। এর ফলে আঘাতপ্রাপ্ত কিশোররা অচেতন হয়ে পড়ে। তারপর তাদের জ্ঞান ফিরলে আবারও একই কায়দায় মারধর করে ডরমেটরিতে ফেলে রাখা হয়।

এসপি বলেন, সেদিন তাপমাত্রাও বেশি ছিল। সারা দিন কিছু খেতে না দেওয়া ও চিকিৎসা না করে ফেলে রাখা হয়। অবস্থা গুরুতর হলে একজন কম্পাউন্ডারকে ডাকা হয়। ব্যর্থ হয়ে সন্ধ্যায় মরণাপন্ন অবস্থায় নাঈম নামে এক কিশোরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে চিকিৎসক জানিয়ে দেন, হাসপাতালে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ প্রায় ৬ ঘণ্টা পর হাসপাতাল সূত্রে এই ঘটনার খবর জানতে পারে। এরপর কেন্দ্রে গিয়ে ডরমেটরি থেকে আরো দুই কিশোরকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। একই সঙ্গে আহত ১৫ জনকে হাসপাতালে পাঠায়। কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা পুলিশ, জেলা প্রশাসন বা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানায়নি।

এসপি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সন্দেহে ১০ জনকে প্রথমে হেফাজতে নেওয়া হয়। পরে আরো ৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরপর যাচাই-বাছাই করে পাঁচজনের সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং পাঁচজনকে সাক্ষী হিসেবে পেয়েছি।

এদিকে গ্রেপ্তার পাঁচ কর্মকর্তাকে দুপুরে যশোরের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহাদি হাসানের আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। আগামী ১৭ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য হয়েছে বলে আসামি পক্ষের আইনজীবী সালাহউদ্দিন শরীফ শাকিল নিশ্চিত করেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন ইনসপেক্টর রকিবুজ্জামান। পুলিশ সুপার জানান, অধিকতর তদন্ত শেষে খুব শিগগির তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ