৪২ জনকে পাখির মতো গুলি: সাইদুলের চোখে সেই ভয়াবহ দৃশ্য

সাইদুল ইসলাম
সাইদুল ইসলাম

মাদারীপুরের সাইদুল ইসলাম ডিসেম্বরের দিকে ভারত হয়ে লিবিয়া যাত্রা করেছিলেন। দুই দিন আগের দুর্বিষহ স্মৃতি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে ফিরছে। কত দ্রুত আপনজনের কাছে ফিরবেন, সেটাই এখন ২২ বছর বয়সী এ তরুণের একমাত্র চাওয়া। গণমাধ্যমের সঙ্গে মুঠোফোনে এ চাওয়ার কথা জানালেন ভাগ্য বদলের আশায় বিদেশ পাড়ি দেওয়া সাইদুল ইসলাম।

তিনি জানালেন, লিবিয়া পৌঁছানোর পর বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের হাত বদল করে পাচারকারীরা। এরপর তাঁদের জিম্মি করে স্থানীয় অপহরণকারীরা। ওই অপহরণকারীরা টাকার জন্য লোকজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এমনি এক ঘটনায় বাংলাদেশ ও সুদানের লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে অপহরণকারীদের হোতাদের। এরই জেরে বাংলাদেশ ও সুদানের ৩০ নাগরিক প্রাণ হারান অপহরণকারীদের গুলিতে।

লিবিয়ার মিজদা শহরে সেখানকার অপহরণকারীরা গত বৃহস্পতিবার এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ২৬ বাংলাদেশি ও ৪ সুদানিকে হত্যা করে। আহত করে অন্য ১১ বাংলাদেশিকে। ঘটনাস্থলে থাকা ৩৮ বাংলাদেশির মধ্যে অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যান সাইদুল। যদিও এক সারিতে দাঁড় করিয়ে অপহরণকারীরা পৈশাচিক উল্লাসে গুলি চালায় সবার ওপর। বেঁচে যাওয়ার পর গত দুই দিন লিবিয়ার স্থানীয় এক নাগরিকের জিম্মায় ছিলেন সাইদুল।

মাত্র দুই দিন আগে অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান সাইদুল ইসলাম। চোখের সামনেই নিজের দেশের ২৬ জনের নিহত আর অন্য ১১ জনের আহত হওয়ার দৃশ্য ভুলতে পারছেন না তিনি। তাই মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া সাইদুল আজ দুপুরেও স্বাভাবিক হতে পারেননি। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারবার থমকে গেছেন।

সাইদুল বলেন, ‘একদল অপহরণকারী আমাদের জিম্মি করে পরে অন্য একদল মাফিয়ার হাতে বিক্রি করে দেয়। ওই মাফিয়ারা আমাদের বেধড়ক পেটাতে থাকে। ১২ হাজার ডলার চায়, যার মানে হচ্ছে ১০ লাখ টাকা। আমাদের সঙ্গে থাকা লোকজনের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। দরিদ্র বললেও কম বলা হবে। কাজেই এত টাকা দেওয়ার সাধ্য কোথায়!'

নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে সাইদুল জানান, হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে তাঁদের ছাদের সঙ্গে উল্টো ঝুলিয়ে রেখে বেধড়ক পেটায় অপহরণকারীরা। যাঁরা টাকাপয়সা দিতে পারছেন না, তাঁদের মোটা প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে অনবরত পেটানো হয়।

বৃহস্পতিবারের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সাইদুল ইসলাম বলেন, '২৭ রোজার পর অপহরণকারীরা শিবিরে আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। টাকার জন্য অনবরত পেটাতে থাকে। এত টাকা তো সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। এমনও ঘটনা ঘটেছে, টাকা না পেলে তারা পিটিয়ে লোকজনকে মেরে ফেলে। আমাদের ওপর নির্যাতনটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। অনেকের শরীরের বিভিন্ন অংশ পিটিয়ে থেঁতলে দিয়েছে। অপহরণকারীদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই মিলে ঠিক করলাম, এভাবে তো আর অত্যাচার সহ্য করা যায় না, সুযোগ পেলে অপহরণকারীদের ওপর হামলা চালাতে হবে। এই সিদ্ধান্তের পর সুদানের লোকজনই অপহরণকারীদের হোতাকে বুধবার পিটিয়ে মেরে ফেলে। এটা জানার পর মাফিয়ারা শিবির থেকে বাংলাদেশের ৩৮ জন ও সুদানের ৪ জনকে বের করে এনে পাখির মতো গুলি করে। আর আমি যে এখনো অক্ষত বেঁচে আছি, এটাই বিশ্বাস করতে পারছি না।'

এদিকে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর আ স ম আশরাফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক বাংলাদেশি ছাড়া অন্য ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। গুরুতর আহত ওই বাংলাদেশিকে সুস্থ করার জন্য সব রকম চেষ্টা চলছে। সুস্থ হয়ে গেলে ওই ১১ জনকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে দেশে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।

আ স ম আশরাফুল ইসলাম জানান, নিহত ২৬ বাংলাদেশির মরদেহ হাসপাতাল ও পুলিশের সহায়তায় লিবিয়াতেই দাফন হয়েছে। (সূত্র: প্রথম আলো)


সর্বশেষ সংবাদ