হরদম ঈদযাত্রা অ্যাম্বুলেন্সে, মিলছে সার্টিফিকেটও!

রাস্তায় কড়াকড়ি আর সারাদেশে যানবাহন বন্ধ থাকায় লাশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্সে চলছে ঈদযাত্রা। আর এইক্ষেত্রে প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা এখন রমরমা। তারা ভাড়াও হাঁকছেন বেশি। যোগাড় করে দিচ্ছেন রোগীর ভুয়া সার্টিফিকেটও।

ঢাকা জেলা হাইওয়ে পুলিশের ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহেল বাকি। তিনি দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা মানিকগঞ্জ হাইওয়েতে। তার বক্তব্য, ‘‘আগের চেয়ে এখন রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সের চলাচল বেড়ে গেছে। আর আত্মীয়-স্বজন পরিচয়ে যাত্রীও থাকে ঠাসা। রোগী একজন কিন্তু তার সঙ্গে গাড়িতে থাকেন পাঁচ-ছয় জন। আমাদের সন্দেহ হলে থামাই। কখনো কখনো কাগজপত্রও চেক করি। রোগীর কাগজপত্র না থাকলে অ্যাম্বুলেন্স যেখান থেকে আসে সেদিকে ঘুরিয়ে দিই।

‘‘তবে এরমধ্যে অনেক রোগীর কাজগপত্র নিয়ে আমাদের সন্দেহ হয়। কিন্তু চেক করার উপায় থাকে না। ফলে ছেড়ে দিতে হয়।’’

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানাও জানান, ‘‘অনেকেই রোগী সেজে পরিবার পরিজন বা আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন বা ঢাকায় আসছেন।’’ আর প্রায় প্রতিদিনই লাশের গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী বহনের অভিযোগে চালককে জরিমানার খবর পাওয়া যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দি হাসপতালের সামনে এখন ঢাকার বাইরে যাবার জন্য অ্যাম্বুলেন্স দরদাম করার দৃশ্য প্রায় স্বাভাবিক।

লাশের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী পারাপার:  বুধবার পরিচয় গোপন করে ঢাকা প্রতিনিধি যোগাযোগ করেন দুইজন প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স মালিকের সঙ্গে। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে সার্ভিস দেন। তাদের একজন আব্দুর রহমান (ছদ্মনাম) প্রথমে নানা প্রশ্নের পর যাত্রী নিয়ে ঢাকার বাইরে বরিশাল যাওয়ার প্রস্তাবে সম্মত হন। তবে কড়াকড়ির কারণে তিনি বেশি ভাড়া দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘‘ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এখন ফেরি চলাচল বন্ধ বলে যমুনা সেতু হয়ে অনেকটা পথ বেশি ঘুরে যেতে হবে। তাই আজকে (বুধবার) ভাড়া লাগবে ৪০ হাজার টাকা। রাস্তার ঝামেলা আমিই মিটাবো। যদি ফেরি চলাচল শুরু হলে যায় তাহলে ১২-১৪ হাজার টাকা লাগবে।’’

অবশ্য এত খরচ এড়াতে তিনি বিকল্প প্রস্তাব দেন। যাত্রী দুই তিনজন হলে আত্মীয় পরিচয়ে রোগীর অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে প্রতিজনের ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। আর তারা লাশও পরিবহণ করেন। লাশের গাড়িতেও আত্মীয় পরিচয়ে তুলে দিতে পারেন। সেজন্য জনপ্রতি ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা।

তিনি জানান, ‘‘প্রতিদিনই পুরো অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা ছাড়াও লাশের গাড়ি ও রোগীর গাড়িতে অনেকেই ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন। এখন লাশের গাড়িই বেশি৷ আবার বাইরে থেকে ঢাকায় ফিরে আসার সময়ও যাত্রী নিয়ে আসা হয়।’’

গত কয়েকদিনে রাস্তায় কড়াকড়ি থাকায় অনেক সময় পুলিশকে ম্যানেজ করতে হয় বলে জানান আরেকজন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। তিনি বলেন, ‘‘এমনিতে ফেরি বন্ধ থাকলেও রোগীর অ্যাম্বুলেন্স ও লাশের গাড়ি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়না। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করা হয়৷ তবে এখন ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফেরি বন্ধ থাকায় একটু সমস্যা। আর যেখানে যেতে ফেরি দরকার হয় না সেখানে সমস্যা কম। শুধু কিছু ক্ষেত্রে চেকপোস্টে পুলিশ ধরলে ম্যানেজ করতে হয়।’’

রোগীর ভুয়া ছাড়পত্র
কিন্তু সবচেয়ে ভালো ‘সমাধান’ দিলেন আরেকজন প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স মালিক দিলদার হোসেন (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘‘আপনি যদি পুরো অ্যাম্বুলেন্সই নিয়ে যেতে চান তাহলে একজনকে রোগী সাজাতে হবে। কোনো একটি হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে একজনের পায়ে বা মাথায় ব্যান্ডেজ করে সঙ্গে চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে নেব। এজন্য বাড়তি মাত্র তিন-চারশ’ টাকা খরচ হবে। আর আমিই এটার ব্যবস্থা করে দেব। ফলে পথে আর পুলিশ ঝামেলা করতে পারবে না।’’

সাজানো রোগীতে জমজমাট অ্যাম্বুলেন্সব্যবসা: ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর সারাদেশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অ্যাম্বুলেন্স ও লাশের গাড়ির এই ব্যবসা শুরু হয়। আর এখন কড়াকড়ি হওয়ায় ব্যবসাটা আরো বেড়েছে। ভাড়াও আগের চেয়ে বেশি। জরুরি সেবা ও পণ্য পরিবহনের গাড়ি ও ট্রাকের ড্রাইভাররাই পণ্যের সাথে যাত্রী বহনের ব্যবসা করেন।
প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির হিসেবে সারাদেশে তাদের সদস্য অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা আট হাজার। এর মধ্যে ঢাকায় আছে দুই হাজার ৫০০। এর বাইরেও সমিতির সদস্য নয় এমন সারাদেশে আরো তিন হাজারের মত প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স আছ। সরকারি হাসপতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালেও প্রায় সমপরিমান অ্যাম্বুলেন্স আছে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স প্রকৃত রোগী ছাড়া পাওয়া না গেলেও রোগীর অ্যাম্বুলেন্স এবং লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে ড্রাইভারেরা টাকার বিনিময়ে যাত্রী বহন করেন।

প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন, প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী বহনের কথা স্বীকার করে।৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এরকম যাত্রী বহনের অভিযোগ প্রতিদিনই পাই। পুলিশ চেকপোস্টে আটকও করা হয়। তবে যাত্রী নেয়ার কোনো বিধান নেই। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি না। তবে এসব ক্ষেত্রে আমরা অ্যাম্বুলেন্স ছাড়ানোর জন্য পুলিশের কাছে কোনো তদবির করি না।’’

এই সময়ে হাসপতালগুলোতে করোনার কারণে সাধারণ রোগী অনেক কম। আর অ্যাম্বুলেন্সে করোনা রোগী বহনে আছে অনীহা। তারপরও অ্যাম্বুলেসগুলো বসে নেই৷ মূলত রোগীর নামে তারা এখন যাত্রী বহনেই বেশি মন দিয়েছেন। আলমগীর হোসেন দাবি করেন, ‘‘যাত্রীরা রোগী আছে বলে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন। তারপর যদি রোগী না থাকে তাহলে আমাদের কিছু করার থাকে না। আমরা তো আর রোগীর কাগজপত্র দেখতে চাইতে পারিনা।’’

ফেরিঘাট থেকে ফেরত
এদিকে মাওয়া এবং পাটুরিয়া ফেরিঘাটে নদী পার হওয়ার অপেক্ষায় যারা ছিলেন তাদের অনেককেই পুলিশ বাস ভাড়া করে ঢাকায় বা যেখান থেকে গিয়েছিলেন সেখানে ফেরত পাঠিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ফেরি বন্ধ থাকায় তাদের অধিকাংশই নদী পার হতে পারেননি। তবে কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্পিডবোট ও ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে নদী পার হয়েছেন।-ডয়েচে ভেলে


সর্বশেষ সংবাদ