বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্থান চিহ্নিতের উদ্যোগ নেই

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। জয় বাংলা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দাঁড়িয়ে লাখ জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। জাতির পিতার দেওয়া ভাষণের সেই স্থান চিহ্নিতের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। এক বা একাধিক কমিটি গঠন করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিতের উদ্যোগ নিতে সরকারকে বলা হয়। কিন্তু ঐ রায় ঘোষণার পর পেরিয়েছে এক দশক। এখন পর্যন্ত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণগুলোর স্থান চিহ্নিত করা হয়নি। এ নিয়ে সম্প্রতি উষ্মা প্রকাশ করে হাইকোর্ট।

আদালত বলে, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংরক্ষণ করা নিয়ে ২০০৯ সালে রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও ঐ রায়ের বাস্তবায়ন নেই। বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বাধীন সরকার এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরেও যদি ঐতিহাসিক রায় বাস্তবায়িত না হয় তাহলে কে করবে।’ আদালত বলে, সরকারি কর্মকর্তাদের কতভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সরকারের নীতি বাস্তবায়নে উনাদের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। এটাই হলো আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র। ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করার নির্দেশনা সংক্রান্ত রিট মামলার শুনানিতে ঐ রায়ের প্রসঙ্গ উঠে এলে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। আদালত বলে, ‘ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত স্থানকে নষ্ট করতেই পরবর্তীকালে সেখানে শিশুপার্ক করা হয়।’

এ প্রসঙ্গে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার বলেন, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের স্থান চিহ্নিতকরণের কোনো কাগজ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আমাদের কাছে পাঠানো হয়নি। ফলে আদালতে এ সংক্রান্ত কোনো নথি উপস্থাপন করতে পারিনি। তিনি বলেন, ১০ বছর আগে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিল এখন সেটাই বাস্তবায়নের আদেশ দেবে আদালত।

সোহারাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ চিহ্নিত ও সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন। সর্বমোট পাঁচটি ভাষণ ঐতিহাসিক ভাষণ রমনা রেসকোর্স ময়দানেই প্রদান করা হয়েছিল বলে রিট মামলায় বলা হয়। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ঐ রিটের ওপর ২০০৯ সালের ৮ জুলাই রায় দেন।

রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। দুই যুগ ধরে তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে যেভাবে প্রস্তুত করেছিলেন জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার প্রত্যাশামতে বাঙালি সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা দাবি করল। এই দাবির প্রেক্ষাপটে ২৩ বছরের বঞ্চনা ও ষড়যন্ত্রের ইতিহাস বর্ণনা করে শেখ মুজিব ঘোষণা করলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সামরিক জান্তাকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ না দিয়ে তিনি বাংলার জনগণকে এভাবে স্বাধীনতার ডাক দিলেন। যা নিঃসন্দেহে ইতিহাস সৃষ্টি হলো।

রায়ে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্য আছে। শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র ঐ এলাকা। এই প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ এলাকাটি বিশেষ এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের দাবি রাখে। এখানে এমন কোনো স্থাপনা থাকা উচিত নয় যে এই এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারে।

চলতি মাসে হাইকোর্টের এক আদেশের প্রেক্ষিতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চিঠি দিয়ে জানায় যে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাস্তবায়নাধীন স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে ৭ মার্চের ভাষণস্থলে মঞ্চ পুনর্নির্মাণও বঙ্গবন্ধুর তর্জনি উত্তোলিত প্রতিকৃতি স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতিমধ্যে স্বাধীনতাস্তম্ভ প্রকল্পের দুটি পর্যায়ে গ্লাস টাওয়ার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর, ফোয়ারা, জলাধার ও উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। চলছে শিশু পার্ক পুনর্নির্মাণের কাজ। (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, প্রতিবেদক: দিদারুল আলম)


সর্বশেষ সংবাদ