আর কখনো যৌনকর্মীর জানাজা পড়াবেন না সেই ইমাম

  © সংগৃহীত

এমাসের গোড়ার দিকে প্রথা ভেঙে দৌলতদিয়ার একজন যৌনকর্মীর জানাজা পড়িয়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছিলেন যে মসজিদের ইমাম, তিনি বলছেন, তিনি ভবিষ্যতে আর কখনো কোনো যৌনকর্মীর জানাজা পড়াবেন না।

দৌলতদিয়া রেলস্টেশন মসজিদের ইমাম গোলাম মোস্তফা বিবিসিকে বলছেন, হামিদা বেগমের জানাজা পড়ানোর পর তিনি স্থানীয়ভাবে সমালোচনার মুখে পড়েছেন।

যদিও যৌনকর্মীদের জানাজা বা দাফনের ব্যাপারে কোন ধর্মীয় বিধিনিষেধ আছে কি না, তেমন কিছু উল্লেখ করছেন না মি. মোস্তফা, কিন্তু তিনি বলছেন তিনি এই জানাজা পড়াতে রাজি ছিলেন না, স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তাদের অনুরোধে তিনি পড়িয়েছিলেন।

বিবিসিকে তিনি বলছেন, "এইখানে তো সমালোচনা হচ্ছে। গ্রামের লোক, দোকানদার সবাই আমার সমালোচনা করছে। এতোদিন জানাজা হয় নাই, আমি কেন হঠাৎ করে জানাজা পড়াইলাম?"

"ভবিষ্যতে আর জানাজা পড়ানোর নিয়ত নাই। বিভিন্ন আলেমের সঙ্গেও কথা বলছি। তারাও নিষেধ করছে। পল্লীর লোকেরা অন্য কাউকে দিয়ে জানাজা, দাফন করাইতে পারে। কিন্তু আমাকে পাবে না।"

প্রথা ভেঙে যৌনকর্মীর জানাজা এবং ধর্মীয় রীতিতে দাফনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর এই ঘটনাটি যৌনপল্লীর বাসিন্দাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছে তা দেখতে দৌলদিয়া গিয়েছিলাম আমি।

সেখানে গিয়েই জানতে পারলাম ইমাম গোলাম মোস্তফার সামাজিকভাবে নিগ্রহ হবার হবার খবর।বাংলাদেশে যৌনপেশা বৈধ হলেও এই পেশাজীবীদের খারাপ চোখে দেখা হয়, সমাজ থেকে তারা একরকম বিচ্ছিন্নও থাকেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙ্গে একজন যৌনকর্মীর জানাজার ঘটনা তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে কতটা কাজ করবে?

হামিদা বেগমের কবর

 

মর্যাদার সঙ্কট: পঁচিশ বছর ধরে দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লীতে আছেন রানু বেগম (ছদ্মনাম)। এই পল্লীতেই জন্ম দিয়েছেন একে একে ৪টি সন্তানের। দীর্ঘ জীবনের হিসেব মিলিয়ে প্রাপ্তির খাতায় বঞ্চণা আর অপমান ছাড়া কোন কিছুই দেখেন না তিনি।

তিনি বলছিলেন, "এই জগতটা তো দেখা হয়ে গেছে আমার। কিছুই নাই। শুধু অপমান। এখনো যদি ধরেন আমরা রাস্তায় বা গ্রামের দিকে যাই, কয় কি যে ঐতো অমুক জায়গা থিকা অমুক মানুষ আইছে। আমাগো দেখলে দরজা আটকায় দেয়, বাড়ির উপর দিয়া গেলে কয় এখান দিয়া যাইবা না। অন্য রাস্তা দিয়া ঘুইরা যাও। আমরা এইসব কথা শুইনাও না শুনার মতোন কইরাই থাকি।"

তিনি জানাচ্ছেন, আগে গ্রামবাসী নিয়ম করে দিয়েছিলো কোন যৌনকর্মী বাইরে বের হলে খালি পায়ে বের হবে। তবে এখন অবশ্য সে নিয়ম আর নেই। রানু বেগম যে মানবিক মর্যাদার সঙ্কটের কথা বলছেন, এই পল্লীর সকলকেই সেই সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয় কোন না কোনভাবে। ফলে এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা সবসময়ই চেষ্টা করেন নিজেদের বাইরের জগত থেকে আড়াল করে রাখতে।

এমনকি বাইরের কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলেও নিজেদের প্রকৃত নাম-পরিচয় গোপন রাখতে হয়। যেমন মাত্র ৬ মাস আগেই অপারেশনের মাধ্যমে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন বৃষ্টি আক্তার (ছদ্মনাম)। তিনি বলছেন, চিকিৎসা নেয়ার সময় নিজে থেকেই পরিচয় গোপন রেখেছিলেন।

"আমি ঠিকানা দিছি দৌলতদিয়া। কিন্তু আমাদের পল্লীর ঠিকানা হইলো পূর্বপাড়া। আমার নামও দিছি অন্য। আসল পরিচয় যদি দেই আমি তাহলে তারা তো জানবে আমি কে। আমাকে তখন খারাপ জানবে। আর খারাপ জানলে তো খারাপভাবেই দেখবে।"

দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীরা শুরু থেকেই ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হলেও তেমন কোন নাগরিক সুবিধা নেই তাদের। বয়স হয়ে গেলে নিদারুণ সমস্যায় পড়েন অনেকেই। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে মৃত্যুর পরও ধর্মীয়ভাবে দাফন-কাফনের অধিকার না পাওয়ার হতাশা দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ করে এসেছেন তারা।

তবে বছরের পর বছর না হলেও হামিদা বেগমের জানাজা ও দাফন ধর্মীয় রীতি মেনে সম্পন্ন হলে, যৌনকর্মীদের মধ্যে তো বটেই আলোড়ন তুলেছে এর বাইরেও।

পাপের বোঝা কার?

বাংলাদেশে যৌনপেশাকে সামাজিকভাবে খারাপ চোখে দেখা হলেও হামিদা বেগমের ছেলে বলছেন, তারা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আটকে থাকতে চাননি।

"আমার মা যেখানেই থাকুক, যে কাজই করুক, তার একটা পরিচয় আছে যে সে মানুষ। আমরাও মানুষ, আমরাও মুসলমান। আমরা চাইছিলাম মৃত্যুর সময়টাতে যেনো অন্ততঃ মানুষ হিসেবে সম্মান পাই। সেই জন্যেই আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন করছিলাম।"

এটা নিয়ে যৌনকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে বাইরে এর সমালোচনাও হচ্ছে প্রচুর। যদিও এর কোন যৌক্তিকতা খুজে পান না যৌনকর্মীদের একজন নেত্রী। তিনি বলছিলেন, এদেশের সমাজ পাপের বোঝা শুধু যৌনকর্মীদের উপরই চাপাতে চায়।

তিনি বলছেন, "পাপতো এখানকার মেয়েরা একলা করতেছে না। তারা করতেছে পেটের দায়ে, ক্ষিধার চাহিদা মেটানোর জন্য। আর আপনি আসতেছেন আপনার মনোরঞ্জন করার জন্যে। তাহলে পাপটা কার হইতেছে?"

"এইখানে যৌনপল্লীতে ধর্মের বিধান ভাইঙ্গা আসে কারা? আপনারা। তাইলে আপনাদের যদি সমাজে মাটি হয়, তাইলে আমাদের হবে না কেন?"

বিরূপ এলাকাবাসী: দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীরা আশাবাদি যে, হামিদা বেগমের জানাজার পর সেটা হয়তো যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে কাজে দেবে। কিন্তু বাস্তবে পল্লীর বাইরে খোঁজ নিতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এর উল্টো মনোভাবই দেখা গেলো। যৌনপল্লীর পাশেই দৌলতদিয়া রেল স্টেশন। সেখানেই স্টেশন মসজিদের কাছে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে।

এর মধ্যে হামিদুল ইসলাম নামে একজন জানালেন, যৌনকর্মীর পেশাটাই যেখানে ধর্ম সমর্থন করে না সেখানে সারাজীবন সেই পেশায় থেকে শেষ সময়ে ধর্মের দরকার কী? তিনি বলছেন, "ঐখানে তো অন্য মানুষজন থাকে। ঐটা তো আলাদা জায়গা। পতিতালয়। সেইখানে ধর্মীয়ভাবে জানাজা হয় কিভাবে?"

মনির হোসেন নামে আরেকজন বেশ ক্ষিপ্ত। তার ক্ষোভ ইমাম সাহেব কেন জানাজা পড়ালেন সেটা নিয়ে।

তিনি বলছেন, "হুজুর তো আগে আমাদের সমাজ থেকেই মত গঠন করবে। জানাজায় নেয়া যাবে কি-না, সেইটা তো গ্রামের লোক বসে পদ্ধতি ঠিক করবে। তারপরে সে আমাদের মর্জি নিয়ে সেখানে যাবে। তাকে তো ইমামের দায়িত্বে রাখছি আমরা। সে একাএকাই কেন গেলো?"

এবার বোঝা গেল ইমাম গোলাম মোস্তফা কোন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে আর কখনো কোন যৌনকর্মীর জানাজা না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

(প্রতিবেদক: তাফসীর বাবু, বিবিসি বাংলা)


সর্বশেষ সংবাদ