অ্যাম্বুলেন্স বাঁচাবে রোগী, অ্যাম্বুলেন্সকে কে?

  © ফাইল ফটো

রোগী পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত অধিকাংশ অ্যাম্বুলেন্স স্বাস্থ্যসম্মত রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এসব বাহন ব্যবহারকারীরা নানা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ দেশে এ সংশ্লিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসুস্থ মানুষের জরুরি সেবা দিতে সারাদেশে প্রায় ৬ সহস্রাধিক অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। যেগুলো নিয়মিতভাবে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্তদের হাসপাতাল ও বাসস্থানে আনা-নেওয়ার কাজ করছে। তবে দিনের পর দিন এসব বাহনে জটিল সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীরা যাতায়াত করলেও সেগুলোকে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। সরেজমিন একাধিক বেসিরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক, সহকারী ও এসব যানবাহন ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবার-পরিজন তথা আত্মীয়-স্বজনের অসুস্থতায় জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবার প্রয়োজন হলে যানটিতে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ আছে কিনা তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বিবেচনার বিষয় মাথায় থাকে না। বরং রোগীকে দ্রম্নত চিকিৎসাকেন্দ্রে নেয়াই মুখ্য হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে অ্যাম্বুলেন্সে সুপ্ত ক্ষতিকর সূক্ষ্ম জীবাণু দ্বারা শতভাগ আক্রান্তের ঝুঁকি থাকলেও বিষয়টি বিবেচনার উপায় থাকে না।

অ্যাম্বুলেন্স অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী, মিডফোর্ড হাসপাতালসহ অন্তত ১০টি সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শয্যা সংখ্যা অনুপাতে তারা একটি হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ১০ জন মুমূর্ষু রোগীকে বিভিন্ন জায়গায় আনা-নেওয়া করেন। এক্ষেত্রে এমনও রোগী আছে যারা অসুস্থতাজনিত কারণে অ্যাম্বুলেন্সে পায়খানা-প্রসাব ও বমি করেন। অনেকের শরীর থেকে রক্ত-পুঁজ ঝরায় দুর্গন্ধে গাড়িতে অবস্থান করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এতে অ্যাম্বুলেন্সে অবস্থানকারী অনেক রোগীর স্বজনও অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার হাসপাতালে নিয়মিত গাড়ি ধোয়ারও ব্যবস্থা না থাকায় চালকের পকেটের অর্থ খরচ করে ধোয়া-মোছার পর ভাউচার প্রক্রিয়ায় খরচ তুলতে হয়। এতে করে কালক্ষেপণ ও বিড়ম্বনা হওয়ায় নিয়মিত গাড়ি ধোয়াও হয় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভাড়ায় চালিত কয়েকটি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও সহকারী বলেন, রোগী পরিবহনের ক্ষেত্রে দেশের বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সই স্বাস্থ্যসম্মত শর্ত মানা হয় না। অনেক অ্যাম্বুলেন্স আছে যেগুলো পিকআপ ভ্যান কেটে মাইক্রোবাস করে অবৈধভাবে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এসব বাহনে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিয়মিত অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে এমন বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করে জনস্বাস্থ্যবিদরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে সমস্যা সমাধানে উন্নত বিশ্বের ন্যায় এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে পরিবহনে (অ্যাম্বুলেন্স) রোগীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে ঝুঁকি কমবে বলেছেন। এজন্য প্রথমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, অ্যাম্বুলেন্স মালিক, চালক-সহকারীদের সহযোগিতা ও এটি ব্যবহারকারী রোগীর স্বজনদের সচেতনতা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন।

জনস্বাস্থ্যবিদরা আরও অভিযোগ করেন, চিকিৎসাসেবার সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিষয় হওয়ায় ২০১৮ সালের শুরুর দিকে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার নীতিমালার একটি খসড়া তৈরি হলেও তা পাস হয়নি। মূলত অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যোগসূত্র না থাকা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদিচ্ছা ও জবাবদিহিতার অভাবে এমনটা হচ্ছে। এ সুযোগে কতিপয় অসাধু চক্র বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) লাইসেন্স ও রুট পারমিট নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে সাধারণ মাইক্রোবাস ব্যবহার করছেন। অসহায় রোগী স্বজনদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে গাড়িতে লোকদেখানো কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম বসিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতি ছাড়াই নিয়ম বহির্ভূতভাবে রোগী পরিবহণ করছে।

বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন শাখার কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রাজস্ব বিভাগের পরিবহণ দেখভাল করেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স গাড়িগুলো ওপি বা অপারেশনাল পস্ন্যানভুক্ত। আর উপজেলা হেলথ কমপেস্নক্সে সরবরাহকৃত অ্যাম্বুলেন্স কমিউনিটি ক্লিনিক ইউনিটের ইএসডি বিভাগ এবং জেলা সদর হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সগুলো অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা দেখভাল করেন। তাই এ ব্যাপারে ওইসব শাখার পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর ভালো বলতে পারবেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি উপ-পরিচালক (হাসপাতাল-২) ডা. মোহাম্মাদ ইউনুস আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু ডা. ইউনুস অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার নীতিমালা বিষয়ক খসড়া আইন সম্পর্কে অবগত নন এবং বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের কোনো তথ্য জানা নেই বলে মন্তব্য করেন। তবে উপজেলা হেলথ কমপেস্নক্স ছাড়া বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে ১১৮টি সচল, ৩৫টি মেরামতযোগ্য, ৭২টি অমেরামতযোগ্য অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ২১৪টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে ১৬৪ জন চালক রয়েছে বলে জানান।

রোগীবান্ধব একটি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. শহিদুলস্না সিকদার বলেন, সাধারণত দেশে-বিদেশে এ বি ও সি এই তিন ক্যাটাগরির অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহণ করা হয়। বাংলাদেশে সি ক্যাটাগরির অ্যাম্বুলেন্স বেশি ব্যবহৃত হয়। যেহেতু রোগ-জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের হাসপাতালে আনা-নেওয়ার অন্যতম বাহন অ্যাম্বুলেন্স। সেহেতু রোগীকে হাসপাতালে আনার পূর্ব পর্যন্ত প্রি-হসপিটাল কেয়ার প্রয়োজন। কারণ অধিকাংশ সময় এই সেবার অভাবে অনেক রোগীর পথেই মৃত্যু হতে পারে। ফলে রোগী পরিবহণের জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি স্থায়ী শয্যা, প্রতিমুহূর্তের অবস্থা পর্যবেক্ষণে চিকিৎসক-নার্স বা প্যারামেডিক বসার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এছাড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, ভেনটিলেটর, নেবুলাইজেশন প্রযুক্তি, অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং মনিটর ব্যবস্থা, বস্নাড প্রেসার ও তাপমাত্রা পরিমাপ যন্ত্র, সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে পারসোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট মাস্ক, কার্ডিয়াক মনিটর, ইমার্জেন্সি ড্রাগসহ অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণ যেমন; নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউ ব্যবস্থা, স্ট্রেচার ও সাইরেন থাকা বাধ্যতামূলক।


সর্বশেষ সংবাদ