কোটা আন্দোলন ও শিবির নেতার কথিত সেই কনভারসেশনটি ভুয়া!

  © সংগৃহীত

মুনতাসির মাহমুদ নামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক নেতার সাথে শিবিরের কোনো এক নেতার কনভারসেশনের একটি স্ক্রিনশট ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। অনেকে সেটি ফেসবুকে শেয়ার করে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন। তবে ফাঁস হওয়া স্ক্রিনটটি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে সত্য অনুসন্ধানকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বিডিফ্যাক্টচেক’র বিশ্লেষণে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য বিডিফ্যাক্টচেক’র বিশ্লেষণটি হুবহু তুলে ধরা হল- 

এই কনভারসেশনটি কেন ভুয়া?

হোয়াটসঅ্যাপ কনভারসেশনের এই স্ক্রিনশটটি ভাইরাল হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, এটি মুনতাসির মাহমুদ নামে কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক নেতার সাথে শিবিরের কোনো এক নেতার কনভারসেশনের স্ক্রিনশট।

কিন্তু স্ক্রিনশটটিতে থাকা কিছু অসঙ্গতি এবং এটি প্রথম প্রকাশ করা একটি ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে যায়, আসলে স্ক্রিনশটটি বানোয়াট বা ভুয়া।

বলা বাহুল্য যে, হোয়াটসঅ্যাপ কনভারসেশনের ক্ষেত্রে মোবাইল স্ক্রিনে বার্তা প্রেরণকারীর thread থাকে প্রেরণকারীর ডান দিকে আর বার্তা গ্রহণকারীর thread থাকে প্রেরণকারীর হাতের বাম দিকে। কনভারসেশনের একদম উপরে বাম দিকে গ্রহণকারীর প্রোফাইল (নাম-ছবি) ভেসে ওঠে।

আলোচ্য কনভারসেশনের স্ক্রিনশটে বার্তা গ্রহণকারীর প্রোফাইলে দেখা যাচ্ছে, নাম হিসেবে লেখা "Muntasir Vai iiuc" এবং প্রোফাইলে তার মুনতাসির মাহমুদের ছবি। এর মানে কনভারসেশনের বাম thread টি মুনতাসিরের আর ডান thread টি কথিত শিবির নেতার।

প্রথমত লক্ষ্যণীয়, কথিত শিবির নেতা মুনতাসিরের নাম তার মোবাইলে সেইভ করেছেন Muntasir Vai নামে। অর্থাৎ, মুনতাসির শিবির নেতার বয়সে বড় অথবা তাকে খুব সম্মান করে ‘ভাই’ হিসেবে সম্বোধন করেন। কিন্তু কনভারসেশনে দেখা যাচ্ছে, তিনি সম্বোধনের ক্ষেত্রে শুরুতেই বলছেন, ‘সকল সাথী এবং কর্মী ভাইদের জানিয়ে দাও’। এখানে ‘দাও’ শব্দের দ্বারা তিনি মধ্যম পুরুষে নির্দেশ দিচ্ছেন। অর্থাৎ, এখানে স্পষ্টতই মুনতাসিরকে কথিত শিবির নেতার চেয়ে বয়সে ছোট কেউ মনে হচ্ছে। এটি ‘ভাই’ বলে সম্বোধনের সাথে পরস্পরবিরোধী।

পরের আরেক বাক্যে কথিত শিবির নেতা তার Muntasir Vai এর উদ্দেশে ‘রাখিও’ বলে নির্দেশ জারি করেন। ওদিকে Muntasir Vai ‘আপনার’ বলে সম্বোধন করছেন।

দ্বিতীয়ত লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হলো, কনভারসেশনে সর্বশেষ কথাটি কথিত শিবির নেতা বলেছেন রাত ১টা ২৬ মিনিটে (স্ক্রিনশটের একদম নিচের অ্যারো চিহ্ন দ্রষ্টব্য)। আর ঠিক একই সময়ে, অর্থাৎ রাত ১টা ২৬ মিনিটেই এই স্ক্রিনশটটি ক্যাপচার করা হয়েছে। ক্যাপচারের সময় দেখুন মোবাইলের টাইমে (স্ক্রিনশটের একদম উপরে বাম দিকের অ্যারো চিহ্ন দ্রষ্টব্য)।

অর্থাৎ, কথিত শিবির নেতা মুনতাসিরের উদ্দেশ্যে ‘সরকার পতনের’ আশ্বাসবাণীটি লিখেই মুহূর্ত দেরি না করে সেই কনভারসেশনের স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছেন!

এবার তৃতীয় বিষয়টির দিকে লক্ষ্য করা যাক। এই স্ক্রিনশটটি রাত ১টা ৫০ মিনিটে ‘আই আই ইউ সি ছাত্রলীগ- Iiuc Chattroleague নামে একটি ফেসবুক পেইজে বাংলায় ৮৭ শব্দের একটি ক্যাপশনসহ আপলোড করা হয়। পোস্টটি দেখুন কমেন্টে যুক্ত করা স্ক্রিনশটে।

অর্থাৎ, কথিত শিবির নেতা নিজের কনভারসেশন শেষ করে স্ক্রিনশট নেয়ার ২৪ মিনিট পরই ৮৭ শব্দের বর্ণনাসহ ছাত্রলীগের একটি সক্রিয় পেইজে সেটি প্রকাশ পেয়েছে!

এখন দুটি প্রশ্ন আসে--

ওই শিবির নেতাটি নিজের শ্রদ্ধেয় ‘বড় ভাই’কে ‘সরকার পতনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজের’ গোপন ‘নির্দেশ’ দিয়ে সেটির স্ক্রিনশট তুলে রাখলেন কেন? বরং সাধারণত এ ধরনের গোপনীয় কাজের প্রমাণ সাথে সাথে মুছে ফেলাই তো বুদ্ধিমানের কাজ।

আর যদি তুলে রাখলেনই, কিন্তু সেটি তিনি অতি অল্প সময়ে ছাত্রলীগকে তাদের ফেসবুক পেইজে আপলোড করার জন্য দিলেন কেন?

একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে যে, ১টা ২৬ মিনিটে মুনতাসিরের সাথে কনভারসেশন শেষ হওয়ার মুহূর্তেই ছাত্রলীগের হাতে ওই শিবির নেতা আটক হয়ে যান এবং ওই মুর্হূতেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তার মোবাইলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেই মুর্হূতেই সেটি স্ক্রিনশট নিয়ে ফেলেছে। খেয়াল করার বিষয় হলো, এই পুরো ঘটনাগুলো কিন্তু ১ মিনিটের কম সময়ের মধ্যে ঘটতে হবে-- কনভারসেশন শেষ হওয়া, ছাত্রলীগের হাতে শিবির নেতার আটক হওয়া, তার মোবাইলের নিয়ন্ত্রণ নেয়া এবং স্ক্রিনশট নেয়া।

বাস্তবে এরকম হওয়ার সুযোগ নেই। আর যদি এমনটি হয়েও থাকতো, অর্থাৎ শিবির নেতার কনভারসেশন শেষ হওয়ার পর তাকে আটক করে তার মোবাইলের নিয়ন্ত্রণ নিত ছাত্রলীগ, তাহলে স্ক্রিনশট নেয়ার জন্য ছাত্রলীগকে এত তাড়াহুড়ো করতে হতো না। ধীরে সুস্থে স্ক্রিনশট নিয়ে, শুধু স্ক্রিনশট নয়, আটক ব্যক্তির ছবি এবং ভিডিও নিজেদের ফেসবুক পেইজে প্রকাশ করতে পারতো ছাত্রলীগ।

কিন্তু চট্টগ্রামে ৯ অক্টোবর রাতে ‘সরকার পতনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে’ কোনো শিবির নেতা আটক হয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশিত হয়নি। ছাত্রলীগের ওই ফেসবুক পেইজেই কথিত শিবির নেতার কোনো ছবি/ফুটেজ আপলোড হয়নি।

আরেকটি সম্ভাবনা থেকে থাকতে পারে যে, ওই শিবির নেতাকে আটক করে তার মোবাইল থেকে মুনতাসিরের সাথে কোনো ছাত্রলীগ নেতা/কর্মী কনভারসেশন করেছেন এবং সাথে সাথে সেটির স্ক্রিনশট নিয়ে রেখেছেন। এরপর সেটি আইআইইউসি ছাত্রলীগের ফেসবুক পেইজে আপলোড করা হয়েছে।

কিন্তু এক্ষেত্রে আটক শিবির নেতার ছবি/ভিডিও বাদ দিয়ে শুধু স্ক্রিনশট ফেসবুকে আপলোড করা হওয়ার কথা নয়। এবং এক্ষেত্রে শিবির নেতা আটকের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কথা যা আদৌ হয়নি।

এবার সর্বশেষ সম্ভাবনাটি হচ্ছে, ‘আই আই ইউ সি ছাত্রলীগ- Iiuc Chattroleague’ পেইজটি যারা পরিচালনা করেন তাদের কেউ নিজের মোবাইলে পরিচিত কারো মোবাইল নম্বর Muntasir Vai iiuc নামে সেইভ করে প্রোফাইলে মুনতাসির মাহমুদের একটি ছবি লাগিয়ে দুইজনে এই পাতানো কনভারসেশন শেষে সাথে সাথে স্ক্রিনশট নিয়ে ২৪ মিনিটের মধ্যে ৮৭ শব্দের ক্যাপশন লিখে সেটি তাদের পেইজে আপলোড করেছেন।