মশারি টাঙাতে তবুও অনীহা

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড় দেয়া কোনো এডিস মশা যাতে সুস্থ অন্য কাউকে কামড় দিয়ে এ রোগের বিস্তার ঘটাতে না পারে- এ জন্য সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রত্যেককে মশারি দেয়া হলেও অধিকাংশ রোগী তা ব্যবহার করছে না। এতে হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য স্টাফ ও রোগীর স্বজনদের মধ্যে নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ভীষণভাবে বাড়ছে। রোগীদের এমন অনীহা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে তেমন একটা জোরালো ভূমিকা নেই।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ রোগীর মশারি ব্যবহারের অভ্যাস না থাকায় তারা এ ব্যাপারে অনীহা দেখাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে সরেজমিন রাজধানীর অন্তত ৫টি সরকারি হাসপাতাল ঘুরে প্রায় ৫০ শতাংশকে ডেঙ্গু রোগীকে মশারি ছাড়া থাকতে দেখা গেছে।

এদিকে চলতি মৌসুমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গুজ্বর প্রাদুর্ভাবের ভয়াবহতা সম্পর্কে হাসপাতালগুলোর একাধিক চিকিৎসক বলেন, মূলত বিভিন্ন প্রজাতির মশার কামড়ের ফলে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ হয়। এসব রোগ-ব্যাধি থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় মশার কামড় এড়িয়ে চলা। যা নিজে সচেতন হওয়ার মাধ্যমে সম্ভব। ফলে বাসা বাড়ির মতো হাসপাতালেও মশারির ব্যবহার মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম উপায়। হাসপাতাল এলাকাগুলোতে সব এডিস মশা ডেঙ্গুর জীবাণু বহন না করলেও সেখানে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে সাধারণ এডিস মশা কামড় দেয়ার পর আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে ওই এডিস মশাও ডেঙ্গুর জীবাণু পায়। আর ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা কোনো সুস্থ মানুষকে কামড়ালে সেও আক্রান্ত হবে। ফলে চলামান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু আক্রান্তসহ প্রত্যেক রোগীরই মশারির নিচে শোয়া উচিত।

গত ২০ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হন বেসরকারি অফিসের কর্মচারী আব্দুস সাত্তার (৩০)। এ সময় তার দেখাশোনা করতে গ্রামের বাড়ি পাবনা থেকে এসে ৬ দিন হাসপতাল ছিলেন ছোট ভাই আকতার হোসেন (২৫)। তবে সাত্তার সুস্থ হয়ে ঢাকার কর্মস্থলে যোগ দিলেও বাড়িতে গিয়ে ডেঙ্গুজ্বরে পড়েন আকতার হোসেন। বিষয়টি সম্পর্কে আকতার জানান, হাসপাতালে ভাইয়ের জন্য মশারি ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হলেও তিনি তা ব্যবহার করতেন না। সে সময় তিনি ভাইয়ের সেবায় ব্যস্ত থাকায় মশার কামড়ের শিকার হন। ফলে ভাইয়ের মাধ্যমেই ডেঙ্গু হয়েছে বলে তিনি মনে করছেন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় সেখানে অধিকাংশ ওয়ার্ডে রোগীরা মশারি টানিয়ে ঘুমাননি। হাসপাতালের ৭নং ওয়ার্ডে ৫ দিন ধরে ভর্তি থাকা রাজু আহম্মেদের কাছে মশারি না টানানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনে মশার উৎপাত কম, তাই মশারি টানানো হয়নি।

পাশের বেডেই চিকিৎসাধীন সজল নামে আরেক রোগীকেও মশারির ভিতর রাখা হয়নি। বেডের ওপর মশারি থাকলেও তা এক কোণে জড়ো করে রাখা হয়েছে। সজলের মা শাহানা বেগম অভিযোগ, বেডের ওপর ফ্যান না থাকায় মশারি টানালে বাতাস লাগে না। তাই মশারি টানান না। তবে রাতে মশারি টানান।

এ ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ভর্তি হওয়ার পরপরই হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে মশারি সরবরাহ করা হয়েছে। রোগীদের সব সময় মশারির ভেতরেই থাকতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে ওয়ার্ডের নার্সদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যেসব রোগীই যেন মশারির ভিতর থাকেন। কিন্তু রোগীরা গরমের অজুহাত দেখিয়ে মশারি টাঙায় না। অনেক রোগীর স্বজন ডাবের খোসাসহ হাসপাতাল আঙিনার যত্রতত্র পানি ও বোতল ফেলছে। এ জন্য হাসপাতাল থেকে নজরদারি করা হয়। কিন্তু ব্যক্তি সচেতনতা না বাড়ায় চেষ্টা করেও ফল আসছেনা। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ডেঙ্গু কর্নারে মশারি ব্যবহার বাধ্যমতামূলক করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

অন্যদিকে ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের ষষ্ঠ ও সপ্তম তলার ফ্লোরে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নেয়া অন্তত ২০ জন রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, মশা থেকে বাঁচতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মশারি দিলেও ফ্লোরে পাতা বিছানায় মশারি টানানোর মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে মশার কামড় খেয়েই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। আবার অতিরিক্ত রোগী ও স্বজনদের চাপে রাতে মশার কয়েল জ্বালানোর মতো কোনো উপায় নেই।

এ ব্যপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাছির উদ্দীনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢামেকে তুলনামূলকভাবে মশার উৎপাত কম। তারপরও সন্ধ্যার দিকে সবাইকে মশারি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সিরিয়াস রোগীদের জন্য মশারি টানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যারা বারান্দা ও ফ্লোরে আছে তাদের মশারি টানানোর রশি সরবরাহ করা হয়েছে। এতে করে চিকিৎসক, নার্স ও স্বজনদের চলাচলে সমস্যা হয়। তবে বার্ন ইউনিটে ভর্তি রোগীদের শতভাগ মশারির আওতায় আনা হয়েছে।

প্রসঙ্গত ঢামেক, সোহরাওয়ার্দী ছাড়াও চলতি বছর চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্টাফসহ মিটফোর্ড হাসপাতালে ৪ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৬, বিএসএমএমইউতে ৪, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ৫, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩৪, পিলখানার বিজিবি হাসপাতালে ১৮, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১৩ ও কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রি সরকারি হাসপাতালে ৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ