চলে গেলেন বর্ষীয়ান নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি, বাম আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বর্ষীয়ান জননেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। শুক্রবার রাত ৭টা ৪৯ মিনিটে তিনি রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

ন্যাপ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাঈল হোসেন জানান, গত ১৪ আগস্ট তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়।

মোজাফফর আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ইউনেস্কোর ডিপ্লোমা লাভ করেন। দীর্ঘদিন তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন।

উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের একজন তিনি। প্রায় আট দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমসাময়িক এই বর্ষীয়ান নেতার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম কুশীলব মোজাফফর আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক জীবন বেছে নেন।

২০১৫ সালে সরকার তাকে দেশের সর্বোচ্চ খেতাব ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করে। তবে রাজনৈতিক আদর্শের কারণে তিনি সবিনয়ে এ পদক গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। অধ্যাপক মোজাফফর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করতে গিয়ে তিনি লেখেন, ‘স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার বন্ধু ছিলেন’। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘তিনিই প্রথম জাতীয় নেতা যাকে বাংলার আমজনতা তাদের আপন লোক ভাবতে পেরেছিলেন।’ মওলানা ভাসানী সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ দেশের রাজনীতি বড়লোকের প্রাসাদ থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে নিয়ে আসার ব্যাপারে শেরেবাংলা ফজলুল হকের চেয়ে মওলানা ভাসানীর অবদান কম নয়।’

মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ১৯৩৭ সালে। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি ও তার স্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৫৪ সালে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দেবিদ্বার আসনে মুসলিম লীগের শিক্ষামন্ত্রীকে তিনি পরাজিত করেন। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও হুলিয়া জারি করে। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। তিনি আত্মগোপনে থেকে আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংঘটিত করেন। আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত পাকিস্তান ন্যাপের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। তিনি রাওয়ালপিন্ডির গোলটেবিল বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মূল নেতৃত্বের একজন ছিলেন তিনি। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ওই সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ, সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নিজস্ব ১৯ হাজার মুক্তিযোদ্ধা গঠনের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। অধ্যাপক মোজাফফর ১৯৭৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন।


সর্বশেষ সংবাদ