কুকুরের দুধ খেয়ে বড় হচ্ছেন ফখরুদ্দীন!

  © টিডিসি ফটো

জন্মের ছয় মাসের মাথায় বাবা তালাক দেয় মাকে। দুখী মা পেট চালাতে হাটবাজারে ময়লাআবর্জনা পরিষ্কারের কাজ নেয়। হাটের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে অনাদরে বসিয়ে রাখতো অবুঝ শিশুকে। ক্ষুধায় কান্না করলে হাতের কাজ ফেলে পান করাতো বুকের দুধ। মা খেয়াল করেন এ শিশু বেজায় ভাব বেওয়ারিশ কুকুরের সাথে।

একদিন অবলোকন করেন, আবর্জনার স্তুপের আড়ালে দুই ছানার সাথে মিলে তার শিশুও কুকুরের স্তন চুষছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এরপর কাজের সময় রাস্তার উপর বসিয়ে রাখা হলেও শিশুটিকে চোখে চোখে রাখা হতো। কিন্তু সুযোগ পেলেই নির্ভয়ে কুকুরের স্তন পান করতো শিশুটি। এ জন্য তাকে মারপিটও করা হত।

একদিন শিশুটি হারিয়ে যায়। টানা দুদিন পর পাওয়া যায় মধুপুর পৌরশহরের সান্দার পট্রির জঙ্গলে। সেখানে কুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে খেলছিল সে। এভাবেই কুকুরের সাথে সখ্যতা, বেড়ে উঠা। এখন পৌর শহরের সব কুকুর তার খেলার সাথী। এভাবেই ফখরুদ্দীন ওরফে ফখরার বেড়ে উঠার বর্ণনা দেন মা জমেলা বেগম।

জমেলার বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুর পৌরসভার কাজী পাড়ায়। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে জটাবাড়ির আলীম উদ্দীনের সাথে। তিন মেয়ের পর ফখরার জন্ম ২০১১ সালে। অভাবের সংসারে জমেলার মাথা গোজার ঠাঁই হয় ভাইয়ের ভিটায়।

জমেলা জানান, হাটাচলার বয়স থেকেই কুকুরের সাথে ফখরার অবিশ্বাস্য সখ্যতা। সারা দিন পথ চলা, খাওয়াথাকা এবং নিশিযাপন। শহরের সব বেওয়ারিশ কুকুরের সাথে ভাব হলেও আদুরী আর বাবুলি সর্বক্ষনের সাথী। ওদের নিয়ে মধুপুর পৌরশহর ছাড়াও গাঙ্গাইর, রক্তিপাড়া, আশ্রা, মোটের বাজার, গারো বাজারসহ উপজেলার হাটবাজার ও গ্রামগঞ্জ চষে বেড়ায় ফখরা।

কুকুরের সাথে গড়াগড়ি, গলাগলি, কামড়াকামড়ি ও কসরত দেখিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে। পাঁচদশ টাকা বখশিস পায়। তা দিয়ে কেনে কলা ও পাউরুটি। ভাগাভাগি করে খায় কুকুরের সাথে। দিনের পর দিন কাটে কলা আর পাউরুটিতে।

কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ানোয় অনেকেই গালি দেয়। গায়ে মাখোনা ফখরা। দিন শেষে ফুটপাতে কুকুরের সাথে কুন্ডলি পাঁকিয়ে আরাম করে। মা জমেলা এখন খুবই অসুস্থ। সারাদিন বাসায় পড়ে থাকেন। তিনি জানান, ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন। লাভ হয়নি।

মধুপুর বাসস্টান্ডের পরিবহন শ্রমিক নির্মল সরকার জানান, রাতে কুকুরের পাহারায় ফখরা বাড়ি ফেরে। কাক ডাকা ভোরে ওদের সাথেই বের হয়। নানাস্থানে ঘুরে বেড়ায়। ফখরার তিন বোনের সবার বিয়ে হয়েছে।

বড় বোন শাহিদা জানান, কুকুরের সাথে থাকাখাওয়ায় পড়শিরা বিরক্ত। বকাঝকা করে। কেউ পরিবারের সাথে মিশতে চায়না। এমনকি আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে আসেনা। কিন্তু ফখরা এসবের কিছুই তোয়াক্কা করেনা। অবুঝ প্রাণীর সাথে তার নাড়ির বন্ধন। বোবা প্রাণী ওর অতি আপনজন। বাড়িতে কুকুরের সাথে এক সঙ্গে খাবার না দিলে ফখরা অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে। হাড়িপাতিল ভাংচুর করে। অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে বলে জানান শাহিদা।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মধুপুর পৌর সভার কর্মীরা শহরে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন অভিযানে তার বন্ধু কালু ও ভুলুকে নিধন করে। ফখরা ক্ষেপে যায়। বাড়িতে চেঁচামেচি শুরু করে। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে একদল কুকুর নিয়ে পৌর ভবনে মেয়র মাসুদ পাভেজের সাথে দেখা করে। অভিযোগ দেন, কালু ও ভুলু কখনো মানুষ কামড়ায়না। অথচ পৌর কর্মীরা তাদেরকে নিধন করেছে। মেয়র ফখরাকে নানাভাবে বুঝিয়ে বিদায় করেন।

এ ব্যাপারে মেয়র মাসুদ পারভেজ জানান, ফখরার কুকুর প্রীতি এবং কুকুরের দুধ পানে বড় হওয়ার খবরটি অনেকের কাছে শুনেছেন। পৃথিবীতে অনেক অবাক কান্ড থাকে। এটি তারই একটি। তিনি আরো জানান, কুকুর নিধনের প্রতিবাদ করতে ফখরা একদিন অফিসে আসে। তাকে আশ্বস্ত করি আর নিধন হবেনা। খুশি হয়ে চলে যায় ফখরা।

পৌর শহরের পাইলট মার্কেটের দোকানি রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, ফখরাকে ছোট্রকাল থেকেই কুকুরের সাথে বড় হতে দেখেছি। কুকুরের দুধ পান করার দৃশ্য অনেকেই অবলোকন করেছেন। মধুপুর পাইলট মার্কেটের গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ভূট্রো সরকার বলেন, আজন্ম কুকুরের সাথে মিতালির দরুন কখনো কখনো ওর মধ্যে অসহিষ্ণু ও ক্ষিপ্ত আচরণ দৃষ্ট হয়। রাগলে গলা দিয়ে অস্বাভাবিক স্বর বের হয়। সর্বক্ষন জিহ্বা বের করে রাখতে পছন্দ। চোখের নির্বিকার চাহনিতে রুক্ষতা দৃশ্যমান। খুবই ছটফটে ও দুরন্ত স্বভাবের। কোথাও এক দন্ড স্থায়ী হয়না।

ফখরা পড়শিরা জানান, ওর কুকুর সঙ্গ বিরত রাখা বিফলে গেছে। জরুরী চিকিৎসা দরকার। মানুষে-কুকুরে এ মিতালি বিস্ময়কর না হলেও স্বভাবে হিংস্র ও মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত ফখরার সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে সহৃদয়বানদের এগিয়ে আসার আর্তি জানান পড়শিরা।


সর্বশেষ সংবাদ