হত্যা করা হয়েছে মুরসিকে, আরব বসন্তের নির্মম ট্রাজেডি!

ডক্টর মোহাম্মদ মুরসি। মিশরের রাজনৈতিক ইতিহাসে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট। একজন প্রকৌশলী, ইসলামি চিন্তাবিদ ও কোরআনের হাফেজ। সারা দুনিয়ায় এই ইসলামপন্হী প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আগ্রহের কোনো শেষ নেই। কারণ আরব বিশ্বের রাজা বাদশা সুলতানদের ক্ষমতার মসনদ কাঁপিয়ে দেওয়া জনগণের এক সফল বিপ্লবের পর মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন তিনি। অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ হচ্ছে তিনি আর নেই! তাও তার মৃত্যুে হয়েছে আদালতের কাঠগড়ায়! জনগণের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট স্বৈরাচারের আদালতে ন্যায় বিচার চাইতে চাইতেই মারা গেলেন! বিশ্ব বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন লিখেছে-

মৃত্যুের আগে কাচের খাঁচায় ঘেরাও করা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মুরসি বার বার বলছিলেন আমিই মিশরের বৈধ প্রেসিডেন্ট। পাঁচ মিনিট বক্তৃতা করার পর তিনি আদালতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।সারা দুনিয়া আজ ধিক্কার জানাচ্ছে তাদের -যারা জনগণের প্রেসিডেন্টকে আদালতের কাঠগড়ায় মৃত্যুের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

০২.
১৯৫১ সালের ২০ আগস্ট মোহাম্মদ মুরসি মিশরের শারকিয়া প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি মিশরের কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশলে স্নাতক শেষ করার পর সে বছরই পিএইচডি করতে চলে যান আমেরিকায়। ভর্তি হন সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে প্রকৌশলে পিএইচডি শেষ করেন ১৯৮২ সালে। তারপর আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সাউথ স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে শুরু হয় তাঁর কর্ম জীবন। ১৯৮৫ সালে তিনি মিশরে ফিরে আসেন এবং মিশরের শারকিয়া প্রদেশের জাগাজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।এই সময়েই সক্রিয় হয়ে পড়েন মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতিতে। আর থেমে থাকেননি।

২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি মিশরীয় পার্লামেন্টের একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ছিলেন যেহেতু মুসলিম ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাবশালী নেতৃত্বে পরিণত হন। তার পরের ইতিহাস সবারই জানা। কিছুটা লিখছি।

০৩.
তিউনিসিয়ার এমএ পাস ফল বিক্রেতা বু আজিজি এখন আর অপরিচিত কেউ নন। আরব বসন্তের মহানায়ক হিসাবে সারা দুনিয়ায় পরিচিত। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর আজিজির ফলের দোকানটি তিউনিসিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদীন বেন আলীর পুলিশ ঘুড়িয়ে দেয়! একমাত্র সম্ভল দোকানটি হাড়িয়ে অসহায় হয়ে পড়ে আজিজি। রাগে দুঃখে ক্ষোভে সারা গায়ে আগুন দিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে গিয়ে আত্মহত্যা করে সে! সাথে সাথেই সারা দেশে স্বৈরাচার বেন আলীর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মশাল জ্বলে উঠে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়ে সৌদি আরব পালিয়ে যান বেন আলী। তিউনিসিয়ার ফল বিক্রেতা আজিজির গায়ে লাগানো আত্মহত্যার আগুন ছড়িয়ে পড়ে আরব বিশ্বের প্রতিটি স্বৈরশাসকের প্রসাদে।যা আরব বসন্ত নামে পরিচিত।

বাদ যায়নি মিশরও, পরিবর্তনের ঢেউ লাগে এখানেও।

২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি মিশরের কায়রোর তাহরির স্কয়ার ৩০ বছরের স্বৈরাচারী শাসক হোসনী মোবারকের পদত্যাগের দাবীতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে। লাখ লাখ তরুণ তরুণী সেই লড়াইয়ে যোগ দেয়। তাহরির স্কয়ারের সেই ঐতিহাসিক ১৮দিনের টানা আন্দোলনে ৮৫০ জনের অধিক বিক্ষোভকারীর বীরের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে পতন ঘটে স্বৈরাচার হোসনী মোবারকের। মোবারক গ্রেপ্তার হন,সেনাবাহিনীর হাতে। তখন থেকেই মিশরীয়রা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মিশরে গণতন্ত্র -ন্যায় বিচার- আইনের শাসনের।

উল্লেখ্য তাহরির স্কয়ারের বিপ্লবের শুরুটা উদারপন্থীরা (যারা খুব সুসংগঠিত ছিল না) করলেও সুসংগঠিত মুসলিম ব্রাদারহুডের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক মো. নিজাম উদ্দিন

০৪.
হোসনী মোবারকের পতনের পর আসে মিশরের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে সেই প্রত্যাশিত জনগণের সরাসরি ভোটে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ২০১২ সাল।মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের নতুন রাজনৈতিক সংস্করণ ফ্রিডম এন্ড জাস্টিজ পার্টি (যেহেতু ব্রাদারহুড নিষিদ্ধ ছিল) গঠিত হল। এই দলের শুরু থেকেই মুরসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে উঠলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রিডম এন্ড জাস্টিজ পার্টির প্রার্থী ছিলেন দলে মুরসির চেয়েও প্রভাবশালী নেতা খাইরাত আল শাতির। মুরসি ছিলেন বিকল্প প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। মামলায় খাইরাত আল শাতির নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলে বিকল্প প্রার্থী মুরসিই তখন ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন।শুরু হয় আরব বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাজনীতির শুভ সূচনা।আরব বসন্তের পর মিশরে জনগণের সরাসরি ভোটে ইসলামপন্থী একজন প্রেসিডেন্টের উত্থান সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়!সেই সময় টাইম ম্যাগাজিন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে নিয়ে কভার স্টরি করেছিল- The most important man of middle east.

তখন থেকেই মিশরের ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট ডক্টর মোহাম্মদ মুরসি আমেরিকা ইসরায়েলসহ পাশ্চাত্য দুনিয়ার মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেন।তারা কোনো ভাবেই মুরসিকে মিশরের বৈধ প্রেসিডেন্ট হিসাবে মেনে নিতে পারেনি।যদিও মুরসি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত।পাশ্চাত্য দুনিয়ায় গণতন্ত্রের চরিত্র এমনই!

শুরু হয় ষড়যন্ত্র!
মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে ফিলিস্তিনের হামাসের আদর্শিক সংযোগ থাকায় মুরসি হঠানোর ষড়যন্ত্রে ইসরায়েলকেও অতি উৎসাহী করে তোলে। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। আমেরিকার মদদপুষ্ট রাজনৈতিক গোষ্ঠী গুলো মিশরে বলতে শুরু করে দিল মিশরের বিপ্লব মুরসির হাতে হাইজ্যাক হয়ে গেছে,সংবিধানে অতিরিক্ত ইসলামি বিধান যুক্ত করে মানুষের অধিকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ইত্যাদি শত অভিযোগ মুরসির বিরুদ্ধে! কিন্তু বাস্তবতা ছিল মুরসি জনগণের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হতেও চেয়ে ছিলেন তাই।সেজন্যই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সাথে সাথে ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির প্রধান চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দেন।

আকাশ চুম্বী জনপ্রিয়তাই হয়ত অপরাধ ছিল তার। মিশরে আরব বসন্তের পর মুরসির নেতৃত্বে পলিটিকাল ইসলামের এক বিস্ময়কর উত্থান মুসলিম বিশ্বকে অনেকদিন পর যোগ্য নেতৃত্বের যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছিল ঠিক তেমনি অসস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় পাশ্চাত্য দুনিয়ার।

বলা হয়ে থাকে পলিটিকাল ইসলামকে আমেরিকা প্রমোট করে থাকে হয়ত বা ঠিক। তবে সেটা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার আগ পর্যন্ত।বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর দিকে থাকালেই তা স্পষ্ট। কোনো দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ইসলামপন্থীদের হাতে চলে যাক এটা আমেরিকা কখনোই চাইবে না সেটা বৈধ পথে হলেও। ইরান তুরস্ক এই জন্যই এদের অসহ্য!

০৫.
শুরু হয় মুরসিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি।মুরসিরই প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেনাবাহিনীর প্রধান আবদেল ফাত্তা আল সিসিকেই বেস্ট চয়েস মনে করে আমেরিকা!দেশে শুরু হয় মুরসির বিরুদ্ধে আমেরিকার পাতানো বিক্ষোভ। এক বছরের মাথায় ২০১৩ সালে সেনাবাহিনীর প্রধান সিসি মুরসিকে হটিয়ে চলে আসে ক্ষমতায়,শুরু হয় মিশরের রাজনীতিতে আবারও এক কঠিন অন্ধকারে পথচলা। গ্রেফতার করা হয় জনগণের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে। একের পর এক মামলায় আসামী করা হতে থাকে তাকে। বিক্ষোভকারীদের দমনে ব্রাদারহুডের সহযোগিতায় তিনি মানুষ হত্যা করেছেন এমন এক অভিযোগে মুরসির বিশ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করে আদালত। মুরসির দলকে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ঘোষণা করে দশ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে সিসি সরকার।এক চরম নিয়ন্ত্রিত শাসন এখন মিশরে।আর সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আরব বিশ্বের স্বৈরাচার, মার্কিন, ইসরায়েল ও পাশ্চাত্য দুনিয়া!

সেই ২০১২ সাল থেকেই মুরসি নিঃসঙ্গ কারাগারে বন্দী।কারও সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। মানবাধিকার সংগঠন গুলোর অনেক উদ্ধেগ উৎকন্ঠা আবেদন সত্ত্বেও অসুস্থ মুরসিকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। একটা স্লো প্রেসেসের মাধ্যমে তাকে হত্যা করাই ছিল সিসির উদ্দেশ্য। অবশেষে তাই হলো!

১৭ জুন ২০১৯।মুরসিকে ফিলিস্তিনের হামাসের সাথে কানেকশানের অভিযোগে এক মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। কাচের ঘেরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিটের মত বক্তব্য করার পরেই মৃত্যুের কোলে ঢলে পড়েন স্বৈরাচারের আদালতে এক জনগণের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হাফেজ ডক্টর মোহাম্মদ মুরসি। মৃত্যুে পর্যন্ত মুরসিই ছিলেন তার দল ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান।

মিশরের ঘটনা আর কোনো দেশে পুনরাবৃত্তি না হোক।

০৬.
গণতন্ত্র, মুক্তি আর পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে আরব বসন্তের সেই ঢেউ যেসব দেশে আচড়ে পড়ে ছিল -সেই তিউনিসিয়া,লিবিয়া,সিরিয়া,লিবিয়া,ইরাক,ইমেয়েন, বাহরাইন কোথাও আজ গণতন্ত্র নেই!প্রতিটা দেশই আজ মুসলমানদের একেকটা কসাই খানায় পরিনত হচ্ছে! কেন? কিছু কিছু ক্ষেত্রে আজ মুসলমানরাই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শক্র! না হয় আধিপত্যবাদের দালাল! অথচ ৫৭টি মুসলিম দেশ ঐক্যবদ্ধ থাকলে মুসলিমদের আজ দেশে দেশে এত মার খেতে হত না। মুসলমানরাও একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে পারতো।

মুরসি ইরান ও তুরস্কের সাথে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের প্রতি।আরব বসন্তের পর আরব বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশের নির্বাচনে সেই সময় পলিটিকাল ইসলামের বিস্ময়কর উত্থানই মার্কিন সমর্থিত সৌদি রাজতন্ত্র ও স্বৈরশাসকদের ক্ষমতার মসনদ কাঁপিয়ে দেয়। ফলে আমেরিকার চাপে নিজেদের স্বার্থে সৌদি বাদশাহ এখন ইসরায়েলের পরম বন্ধু।মুরসিরা কারাগারে,আদালতে মারা যায়! জনগণের দুশমনরাই ক্ষমতায়-আম জনতা পালন করে নিরবতা!

যেকোনো উগ্রবাদকে যেমন প্রচন্ড ঘৃণা করা উচিত ঠিক তেমনি সম্মান শ্রদ্ধা ও সমর্থন থাকা চাই মানুষের ভোটের অধিকারের প্রতি,মতামতের প্রতি।

০৭.
মিশরের তাহরির স্কয়ারের ঐতিহাসিক বিপ্লবের অর্জন এটুকুই- সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি সেনাবাহিনী প্রধান! পরিবর্তন এটুকুই।দুজনেই আমেরিকা ইসরায়েলের দালাল! মাঝখানে যিনি জনগণের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি জীবন দিলেন! এক অদ্ভুত সময়ের মুখোমুখি আজ বিশ্বরাজনীতি। কে ক্ষমতায় থাকবে আর থাকবে না সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আজ জনগণের নেই।

এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিন সাম্রাজ্যেবাদের পরম বন্ধু স্বৈরাচার, রাজা, বাদশাহ, সুলতান আর সামরিক শাসকেরা! জনগণের পক্ষের কোনো রাজনৈতিক শক্তিকেই তারা বাঁচতে দেয়নি!
আর ইসলামপন্থী হলে তো কথাই নেই।

প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসির বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

লেখক: মো: নিজাম উদ্দিন
সদ্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সহসম্পাদক
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ


সর্বশেষ সংবাদ