বাজেটে শিক্ষাকে একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা: ছাত্র ইউনিয়ন

  © সংগৃহীত

শিক্ষাকে একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এবং সার্বিক ভাবে এই বাজেটে নতুন কোন চমক নেই বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জয়পুরহাট জেলা সংসদ।

সোমবার (১৭ জুন) জেলা ছাত্র ইউনিয়নের আহবায়ক রিফাত আমিন রিয়ন এবং যুগ্ম আহবায়ক রেজুয়ান আহমেদ এর স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতি থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

সার্বিক ভাবে এই বাজেটে নতুন কোন চমক নেই। অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন খাতকে শিক্ষায় যুক্ত করে দিয়ে শিক্ষায় বরাদ্দ দেখানোর প্রবণতা এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও লক্ষনীয়। একই সাথে গত দশ বছর ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে শুধু শিক্ষায় বরাদ্দ সবসময় মোট বাজেটের ১০-১১ শতাংশের আশেপাশে ঘুরছে। এবারেও তাঁর ব্যত্যয় ঘটেনি।

শিক্ষাকে একটি বিশেষ শ্রেণির কাছে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টাও এ বাজেটের মধ্যে আছে। দীর্ঘদিনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিন্ন টিউশন ফি’র দাবিকে এবারের বাজেটেও উপেক্ষা করা হয়েছে। শিক্ষাকে বেসরকারীকরন করার একটি প্রচ্ছন্ন রূপরেখাও এই বাজেটে দেখা যায়।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, সার্বিকভাবে এই বাজেট আকারে বিরাট মনে হলেও এই বাজেটের ৬০ শতাংশের উপর ব্যয় নির্বাহ হবে পরিচালনা খাতে। বাকি ৪০ শতাংশের বড় একটা অংশ যাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ বাবদ। প্রস্তাবিত বাজেটের আরেকটা বড় অংশ যাবে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন মেগা প্রকল্প, সড়ক, রেল, সেতু প্রকল্প, বৃহৎ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা গ্রহণসহ সামাজিক সুরক্ষাখাত, মানবসম্পদ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে।

মিডিয়ার বাজেট উপস্থাপনের দরুনই হোক কিংবা বাজেট বিষয়ক আলোচনার কাঠিন্যের কারণেই হোক সাধারণ মানুষের কাছে এখন বাজেটের মূল ফোকাস হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজেটে কিসের কিসের দাম বাড়ল আর কিসের কিসের দাম কমলো। যেটি আসলে বাজেটের প্রধান বিষয় নয়।

শিক্ষকদের ধারাবাহিক আন্দোলন সম্পর্কে বিবৃতিতে বলা হয়, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা এমপিও ভুক্ত কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ এবং এমপিও ভুক্ত কার্যক্রম প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ধারাবাহিক আন্দোলন ও লড়াইয়ের ফসল এবং দেরিতে হলেও আন্দোলনরত শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবী মেনে নেয়ায় মন্ত্রণালয়শিক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।

এবারের বাজেটে বর্তমান বিশ্বে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল শাখায় শীর্ষে থাকা জাপানের পশ্চাৎপদ দেশ থেকে আধুনিক দেশ ও জাতিতে রূপান্তর উদাহরণ টেনে সম্রাট মেইজি’র নীতির অনুসরণ করে বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্লাসরুম গুলোকে ন্যানো টেকনোলজি, বায়ো টেকনোলজি, রোবটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্টস, ম্যাটেরিয়াল,সাইন্স,­ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সহ বিভিন্ন বিষয় উপযোগী ক্লাসরুম নির্মান তথা শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়ন, বৈষম্য দূরীকরণ, গুণগত উৎকর্ষ সাধন ও শিক্ষা সম্প্রসারনের লক্ষ্য নির্ধারন করেছে সরকার। সরকারের এই পরিকল্পনা ও উদ্যোগকেও সাধুবাদ জানিয়েছে নেতৃবৃন্দ।

শিক্ষাঙ্গনসমূহে বিরাজমান সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, বর্তমান সময়ে অতীতের যেকোন সময়ের থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সহ সকল শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের দলান্ধতা, অন্ধ দলীয় আনুগত্য, মাস্তানতন্ত্র, স্তাবকতা এবং লেজুরবৃত্তির মাধম্যে শিক্ষকতা পেশা এমন এক কলুষিত পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শিক্ষকদের যদি নিজেদের আত্ম-উপলব্ধি না হয় তাহলে বিদেশ থেকে শিক্ষক-প্রশিক্ষক এনেও এই পরিস্থিতির কোনরূপ উত্তরণ ঘটানো সম্ভব নয় বরং জনগণের অর্থের নিদারুণ সরকারী অপচয় হিসেবেই এ পরিকল্পনা টিকে থাকবে।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, আমরা বাজেটে শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থ বরাদ্দের প্রকৃত চিত্রের দিকে তাকালে দেখতে পাই। সরকার প্রথমে যেখানে শিক্ষাব্যবস্থাকেই ভবিষ্যতের চালিকাকাঠি বলেছে কিন্তু যখন শিক্ষাব্যবস্থা অর্থ বরাদ্ধের চিত্র আমাদের সামনে আসোলে সেখানে পুরোই বিপরীত ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম।২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষা খাত নিয়ে শুরুতেই একটা ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তি তৈরী হয়েছে। বাজেট বক্তৃতার চতুর্থ অধ্যায়ের ২৬ পৃষ্ঠায় ৮৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষন সংক্রান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন বাবদ এবছর মোট বরাদ্দ ৮৭ হাজার ৬২০ কোটি টাকা যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৬.৭৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.০৪ শতাংশ।

২৮টি মন্ত্রনালয় এবং বিভাগের অভ্যন্তরীণ শিক্ষন ও প্রশিক্ষন কার্যক্রমকে জনপ্রশাসন বা স্ব স্ব বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের বাইরে শিক্ষার সাথে যুক্ত করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রহসন ও প্রতারণামূলক একটা প্রচেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় লক্ষনীয় এবং পুরো ব্যাপারটাই অস্বচ্ছ খাত ওয়ারি এবং বিভাগ ও মন্ত্রনালয় ওয়ারী বরাদ্দের মধ্যে পর্যালোচনা করলে সরাসরি শিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থের সাথে ২৮ টি মন্ত্রনালয় ও বিভাগের শিক্ষা ও প্রশিক্ষন কার্যক্রমের কোন যোগ পাওয়া যায় না। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতকে এক করে মোট বাজেটের ১৫.১৯% বরাদ্দ করে শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেখানোর একটা মেকি প্রচেষ্টাও এই বাজেটে লক্ষনীয়। প্রযুক্তি খাতকে বাদ দিলে শুধু শিক্ষা খাতের বরাদ্দ দাড়ায় ১১.৬৮%। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১১.৫৯%। বর্তমান বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আগের বছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে শতাংশের হিসেবে বেড়েছে ০.০৯%।

বিগত শিক্ষা খাতের বাজেটের সাথে বর্তমান বাজেটের সমালোচনা করে নেতৃবৃন্দ বলেন, সরকার মানসম্মত ও টেকসই উন্নয়নমূলক শিক্ষার স্বপ্ন দেখালেও ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তার যথাযথ প্রতিফলন দেখা যায়নি। শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবার অঙ্গিকার করলেও শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের চালচিত্র বরং উল্টো কথা বলে। বিগত বছর সমূহের ধারাবাহিকতায় এ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও শিক্ষাখাতে টাকার অংকে বরাদ্দ বেড়েছে কিন্ত মোট বাজেটের শতাংশের হিসেব দেখলেই ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া শুভঙ্করের ফাঁকিটা টের পাওয়া যায়।

২০১৯-২০ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সাথে ২০০৯-১০ অর্থ বছরের একটা তুলনামূলক বিশ্লেষন করলে দেখা যায় ২০০৯-১০ অর্থ বছরের চেয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পর্যায় সারণি ৭ অনুসারে শতাংশের হিসেবে ৩.৭ শতাংশ কম এবং সারণি ৬ অনুসারে ৫.০৪ শতাংশ কম।। বর্তমান সরকার এমডিজি লক্ষ্যমাত্র অর্জন ও বাস্তবায়নের অবিস্মরণীয় সাফল্যের ঘোষনা দিলেও সত্য কথন হচ্ছে কখনোই শিক্ষা খাতে নির্ধারিত নূন্যতম লক্ষ্যমাত্রা মোট বাজেটের ২০% বরাদ্দ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বরঞ্ছ বিগত দশ বছর ধরে বিস্মরকর ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ মোটামুটি সব সময়ই মোট বাজেটের ১০-১১% এর আশেই ঘোরাফেরা করছে। শিক্ষায় এমডিজি লক্ষ্যমাত্রার ধারে কাছে ঘেঁষলেও বর্তমানে এসডিজি অর্জনের জন্য সরকারের ব্যাপক তোড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও এর জন্যে দৃশ্যমান ও কার্যকর আন্তরিক কোন উদ্যোগ আমরা দেখি না।

মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যেই পদে আসীন সেই পদের সম্মান রক্ষা করবেন এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষ হয়ে ৪৮ তম বাজেট অধিবেশনের নির্ধারিত আলোচনায় এই বিষয়গুলো তুলে আনবেন এমনটাই আশা ব্যাক্ত করেছেন নেতৃবৃন্দ।

বিবৃতিতে ৭দফা দাবি জানান নেতৃবৃন্দ। দাবিগুলো হলোঃ

১। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত ১১.৬৮% থেকে বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাজেটে সমতা ও ন্যায্যতা সৃষ্টির ভিত্তিতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কর্পোরেট/বানিজ্যিক/­ব্যাংক/বীমা/ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের আয়/লভ্যাংশের উপর শিক্ষা খাতের জন্য বিশেষ সারচার্য আরোপ করা। যাতে করে শিক্ষাখাতে অতিরিক্ত অর্থ সংস্থাপন করা সম্ভব হবে।

২। অন্যান্য বিভিন্ন মন্ত্রনালয় ও বিভাগের সাথে সমন্বয় না করে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয়ের খাতসমূহ আরো বিস্তারিত, সুস্পষ্ট ও সুবিন্যস্ত করা।

৩। শিক্ষার মান-উন্নয়ন তথা মৌলিক দর্শন বিনির্মানে প্রণোদনা,গবেষণা সহায়ক পরিবেশ বিনির্মাণ ও গবেষনা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

৪। প্রতিশ্রুত জিডিপির ৬% এবং মোট বাজেটের ২০% শিক্ষা খাতে দেয়ার অঙ্গিকার বাস্তবায়ন করা।

৫। জিডিপি এবং মোট বাজেটের নির্ধারিত লক্ষমাত্রা পূরণে বাস্তব ও ভিশনারী পদক্ষেপ গ্রহন করা।

৬। মানব সম্পদ হিসেবে বিপুল শিক্ষিত,উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর যে স্ফীতি তা নিয়ন্ত্রনের ভাবনা ভাবার পাশাপাশি চাহিদা ও যোগানের সমন্বয়ের রূপরেখা চূড়ান্ত করা।

৭। শিক্ষার মৌল ভিত্তিকাঠামো, মৌলিক দর্শন কী হবে এবং উচ্চ শিক্ষা, মাধ্যমিক,প্রাথমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা কিভাবে পরিচালিত হবে সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীজন,নাগরিক এবং বিশিষ্টজনদের সাথে আলোচনার লক্ষ্যে বিশেষায়িত টাস্কফোর্স/কমিশন গঠন করা।


সর্বশেষ সংবাদ