আবরার থেকে প্রকৌশলী দেলোয়ার: একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ

ফাহাদ আবরার এবং প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন
ফাহাদ আবরার এবং প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন

ভুলে যাওয়া মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব আর এড়িয়ে যাওয়া ইচ্ছাকৃত স্বভাব। পৃথিবী যত দ্রুত পরিবেশগতভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তার থেকেও বেশি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের আর্থসামাজিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এত বেশি আলোচনার ইস্যু আমাদের সামনে আসে যে দুদিন আগের গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয় দুদিন পরেই হয়ে যায় মূল্যহীন, আবার কখনো কখনো সে ইস্যু আমরা অনায়াসে ভুলে যাই বা এড়িয়ে যাই।

অবশ্য এর একটা বড় কারণ, তার থেকেও নতুন ভয়াবহ সংকট আমাদের আলোচনার স্থান দখল করে নেয়। এভাবেই হারিয়ে গেছে বহু আলোচিত ইস্যু। এভাবেই আমরা হারিয়েছি তনু বা ত্বকী হত্যাকাণ্ড আমরা বিচার চাইতে ভুলেই গিয়েছি সাগর-রুনির মত সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের।

গত বছরের ৭ অক্টোবর একই হলের শিক্ষার্থীদের দ্বারা রাতভর পাশবিক নির্যাতন শেষে মারা যাওয়া বুয়েট শিক্ষার্থী ফাহাদ আবরারের হত্যাকাণ্ডও তেমনি একটি বিষয়। এ হত্যাকাণ্ডে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে হত্যায় সম্পৃক্ত সন্দেহে আটক করা হয় সন্দেহভাজনদের এবং সেই সাথে বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। সারাদেশ সুধী সমাজ এতে সন্তোষ প্রকাশ করে এবং আমরা মনে করি নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ভাল উদ্যোগ ছিল। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করে ফেনীর নুসরাত হত্যার বিচার সম্পন্ন হলেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী থাকা সত্ত্বেও এ হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন হওয়ার সৌভাগ্য এখনো জাতির চোখে পড়েনি। আদৌ কতটা পড়বে সেটা ভবিষতই বলে দেবে।

দুই
এ বছরের গত ১১ মে বিকাল ৪টায় উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। পরে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে তার পরিচয় শনাক্ত হয় যে, তিনি গাজিপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন। উনি কিছুদিন আগেই কিছুটা আলোচিত হয়েছিলেন দুর্নীতির সাথে আপোষ না করায় ওএসডি হয়ে। আর এবার আলোচিত হলেন দুর্নীতি ও অসদুপায়ের বিরোদ্ধে আপোষহীন পথ থেকে চিরতরে ওএসডি হয়ে। যে পথে ওএসডি হলে আর ফেরা যায় না। প্রকৌশলী দেলোয়ার বুঝেছিলেন এই পথে তিনি বেশিদিন চলতে পারবেন না। আর তাই দেশের প্রধান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই মেধাবী ও সৎ প্রকৌশলী চাকরির জটিল পথ ছেড়ে ব্যবসার চিন্তার কথা প্রায়ই বলে আসছিলেন পরিবারের সদস্যদের কাছে।

এমন বড় ও লোভনীয় পদে থেকেও তিনি কতটা হতাশ হলে চাকরি ছেড়ে ব্যবসার চিন্তা করা যায় তা হয়তো তার মত ব্যক্তিত্ববান সৎ কর্মকর্তা ছাড়া আর কারো পক্ষে বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়। সৎ ও নির্লোভ ব্যক্তিদের জন্য পৃথিবীতে চলা সত্যিই যে কঠিন সেই বার্তাই হয়তো জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন দেলোয়ার। এতে কারো না কারো লাভ তো হয়েছেই তবে ক্ষতিটা হয়ে গেলো এই অভাগা জাতির। এই দুষ্টে ভরা ঘুণে ধরা সমাজে আরও দশজন সৎ কর্মকর্তা হওয়ার বাসনা থাকলেও তারা নিজের আর পরিবারের চিন্তা করে এবং দেলোয়ারের পরিণতি ভেবে হত্যাকারী দুর্নীতিবাজদের কথায় হয়তো তাদের কলম সৎ পথে আগাবে না, চরম লুটেরাদের বিলের ফাইলও টেবিলে পড়ে থাকবে না সদুত্তরের আশায়।

‘জ্বী হুজুর’ হয়ে তাদের সাথেই হয়তো হাত মিলিয়ে পরিবার রক্ষা করে গোবেচারার মত জীবন কাটাবে ভৌত কাঠামোর এই উচ্চ শ্রেণীর কর্মকর্তারা অথবা ঠুনকো দেশপ্রেমকে আকড়ে না ধরে উন্নত বিশ্বের বিলাস জীবনে পাড়ি জমাবেন। আর আমরা হয়তো তাদের নিমোক হারাম বলে কয়েকদিন গালাগালি করে থেমে যাবো। এভাবেই একদিন মেধাশূন্য অসৎ কর্মকর্তায় ভরে উঠবে আমাদের পেশাদার সমাজ।

তিন
বুয়েট শিক্ষার্থী ফাহাদ আবরার প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করলেও তার চিন্তা চেতনার পরিধি সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিদ্যা চর্চাও তার দখলে ছিল। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া পোস্টগুলো থেকেই অনুমেয়। একই সাথে তার দেশ নিয়ে ভাবনার গভীরতা ছিল অন্যদের থেকে আরও গভীরে। তার এই দেশপ্রেমই হয়ে উঠেছিল তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের কারন। যে সময় গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক চলছে, প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন, কার্যত বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। সেখানে আবরারের মত সাধারণ শিক্ষার্থীর প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভারত চুক্তির গঠনমূলক সমালোচনা করাই ছিল তার অপরাধ।

প্রকৌশলে পড়ে এত দেশপ্রেম অনেকেরই সহ্য হলো না আর তাই নিছক বিষয়কে কেন্দ্র করেই সারারাত নির্যাতিত হয়ে জীবন দিতে হলো একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতে এই মেধাবী শিক্ষার্থীর। ঠিক একইভাবে প্রকৌশলী দেলোয়ার হত্যার সাথে জড়িত বলে যিনি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনিও দেলোয়ারের সহকর্মী, তিনিও একজন প্রকৌশলী। ‘কাকের মাংস কাকে খায় না’ বলে যে প্রবাদ প্রচলিত তা আমাদের মানব সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়, আবরার বা দেলোয়ারের সহপাঠী বা সহকর্মীরা সেটাই প্রমাণ করেছে।

দুজনের একই পরিণতি হয়েছে বলতে গেলে একই কারণে। দুজনেই দেশের স্বার্থ দেখেছিলেন, দুজনেই তাদের সৎ চিন্তাকেই এগিয়ে রেখেছিলেন। আবরারের জন্য তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে দ্রুত বিচার ও আসামীদের গ্রেফতারে অবদান রাখলেও দেলোয়ারের সহকর্মীদের কোন তৎপরতা এখনো চোখে পড়েনি এবং পেশাদারিত্বে এটা খুব বেশি দেখাও যায় না।

আবরারের হত্যাকারীরা ছিল সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের পদাধিকারী নেতা আর এখানে তাঁর সহকর্মী ও তার ভাড়াটে খুনিরা কোন দলের বা মতাদর্শের বিশ্বাসী তা তদন্ত শেষে হয়তো জানা যাবে। তদন্ত সঠিক হলে হয়তো জানা যাবে কারা বা কেন তাকে ওএসডি করা হয়েছিল কাদের সুবিধার্থে। কিন্ত আমাদের সিদ্ধহস্ত তদন্ত কমিটি যে সময় তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন ততদিনে আরও হাজার খানেক নতুন ইস্যুতে সয়লাব হয়ে হারিয়ে যাবে ফাহাদ আবরারের মত দেলোয়ার হত্যাকাণ্ডও।

চার
সারা পৃথিবী যখন কভিট-১৯ এ আক্রান্ত সেখানে খুনি পিপিই পড়ে নিরাপত্তা নিয়েই খুন করলেন প্রকৌশলী দেলোয়ারকে। ঠিক একইভাবে দেশব্যাপী যখন তারুণ্যের মুক্তিযুদ্ধ চেতনা ও দেশপ্রেমের বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছিল ঠিক তখনই দেশের সার্থের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জীবন দিতে হলো তরুণ এই দেশপ্রেমিক চেতনা লালনকারীকে।

আমরা যদি এভাবে দেশপ্রেমিক ও সৎ ব্যক্তিদের কদর না করি, তাদের হত্যাকান্ডে সঠিক বিচারের দাবিতে তৎপর না হই তাহলে অনিক সরকারের মত অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী গুগল, মাইক্রোসফটে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমাবে। এভাবেই দেশ মেধাশূন্য করে বিদেশে পাড়ি জমাবে দেশের অর্থে পড়াশোনা করা ডাক্তার বা অন্যন্য পেশাজীবীরা।

তখন হাজার উন্নয়নের ছবি চোখে ভাসলেও আমাদের চাতক পাখিদের মত চেয়ে থাকতে হবে উন্নত বিশ্বের কাছে এসব মেধাবীদের কিনে আনতে বা ভাড়ায় চালিত করে। তাই এই হত্যাকান্ডের বিচার হোক ফেনীর নুসরাত হত্যার বিচারের মত দ্রুত সময়ে।

আমরা চাই না তনু, ত্বকী বা সাগর রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের মত আবরার বা দেলোয়ার হত্যাকান্ডের বিচারও হারিয়ে যাক নতুন আলোচনার ভীড়ে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ড গুলির ন্যায়বিচারের মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক ‘দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন’। আমাদের মেধাবী সম্পদেরা নিরাপদ আবাসন গড়ুক আমাদেরই চারপাশে।

লেখক: নাট্যাভিনেতা
ইমেইল: kabilsadi@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ