ইতিহাসের বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার
ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। নানা বিরোধিতার মধ‌্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচার করতে হবে ইতিহাস দিয়ে। শত বর্ষের পথে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠায় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। একটি জাতি বিনির্মাণে যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা পালন করতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উদাহরণই আছে আর তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তার প্রমাণ বিশ্ববাসী দেখেছে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে।

স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ মহান যুদ্ধের অগ্রনায়কদের বেশিরভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষক। মায়ের ভাষায় কথা বলতে যুদ্ধ করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। এরপর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্র-শিক্ষকরা ছিলেন সম্মুখ কাতারে। সর্বশেষ ১/১১’র বিরোধী আন্দোলনেও এগিয়ে আসতে দেখা গেছে এর ছাত্র-শিক্ষকদের। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সবকটি আন্দোলনেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস গর্ব করার মতো একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। তাই হয়তো সাম্প্রতিককালে এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নানা সমালোচনা। আর এসব সমালোচনার যথেষ্ট ভিত্তিও আছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের প্রত্যাশা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা কিছু একটা করছেন। তারা উল্লেখযোগ্য কিছু করেছেন বলে দেখা যায়নি।

করোনার সময় বাদ দিলে পত্রিকার পাতা খুললে যেসব বিষয়গুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায় তারমধ্য উল্লেখযোগ্য হলো- শিক্ষার্থীদের মধ্য মারামারি, গণরুমের দৃশ্য, গেস্টরুমে নির্যাতন, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, শিক্ষকদের গবেষণা চুরি, টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ে দু’পক্ষের মধ্য ধাওয়া পাল্টা ধাওয়াসহ প্রভৃতি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কি ভালো কিছু হয় না? অবশ্যই হয়। তবে তা উল্লেখ করার মতো নয়।

একথা সকলেই মানবেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার গৌরব ধরে রাখতে পারেনি। এখন দেখা যায় যে, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্থান পৃথিবীর এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য নেই। তার মানে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা মেধাবী নন? অবশ্যই মেধাবী। তবে পদ্ধতিগত ভুলের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। কোন শিক্ষার্থী যদি একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তবে জীবনে একটি বই না পড়েও অনার্স ও মাস্টার্স পাস করে যাবেন যদি তিনি পূর্বের শিক্ষার্থীদের পুরাতন কিছু নোট পড়েন।

এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস কত বছর পূর্বে করা হয়েছে তা বলা মুশকিল। আর পরীক্ষা পদ্ধতিও সনাতন। এ পদ্ধতি বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। বই না পড়েও অনেকেই আবার প্রথম শ্রেণী পান এবং তারাই শিক্ষক হন যদি তারা উচ্চতর লবিং বজায় রাখতে পারেন বা দলীয় তকমা অর্জন করেন। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় লবিং বা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত খারাপ রেজাল্ট থাকলেও সমস্যা নেই।

আবার দেখা যায় খুব ভালো রেজাল্ট করেও অনেকেই নিয়োগ পান না লবিং বা দলীয় তকমা না থাকার কারণে। এমনকি বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকলেও তারা নিয়োগ পান না। অভিযোগ আছে যারা একবার নিয়োগ পান তারা গবেষণা কার্যক্রমের চেয়ে দলীয় লেজুড়ভিত্তিকে বেশি গুরুত্ব দেন। অনেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বাদ দিয়ে কোন কোচিং বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় দেয়া গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কোন প্রকার পড়াশোনাই ছাড়াই অনেক শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে আসেন। খোশ-গল্প করেই শেষ করেন নির্ধারিত সময়।

শ্রেণীকক্ষে কোন শিক্ষার্থী প্রশ্ন করল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন অনেক শিক্ষক। এক্ষেত্রে বাস্তব উদাহরণ না দিলেই নয়। সম্ভবত ২০০৫ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সবেমাত্র নিয়োগ পেয়েছেন এমন একজন শিক্ষককে শ্রেণীকক্ষে একটি প্রশ্ন করতেই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন। অকথ্য ভাষায় আমাকে শাসন করেন। যদিও প্রশ্নটি ছিল সিলেবাসের মধ্য থেকে। এখানেই শেষ নয়, ওই শিক্ষক তার কক্ষে আমাকে ডেকে নিয়ে রীতিমত হুমকি দেন। তবে ওই প্রশ্নের উত্তর আর দেননি। সম্ভবত তিনি প্রশ্নের উত্তরই জানতেন না।

আরেকটি উদাহরণ দেই ইংল্যান্ডের। ২০১৭ সাল। আমি তখন বিশ্বখ্যাত ইংল্যান্ডের সিটি ইউনিভার্সিটির বার প্রফেসনাল ট্রেনিং কাের্সের (বার এট-ল’) ছাত্র। শ্রেণীকক্ষেই এক শিক্ষককে প্রশ্ন করি। তিনি শুনে বলেন, এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর তার এখন জানা নেই। জেনে উত্তর দেবেন। পরের ক্লাসের শুরুতেই তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেন। এ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্বের অন্য আরকেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ। সব শিক্ষক অবশ্য এক রকম নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হিসেবে ও ইংল্যান্ডের নামকরা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হিসেবে মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা পিছিয়ে আছেন সবচেয়ে বেশি গবেষণায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি আছে তাতে সকালের দৃশ্য দেখলে মনে হবে ছাত্ররা লাইব্রেরিতে স্থান পাওয়ার জন্য একপ্রকার যুদ্ধ করছেন। ভেতরে গিয়ে দেখা যাবে সবাই বিসিএস বা অন্য কোন পরীক্ষার জন্য পড়ালেখা করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল-পিএইচডি সম্পর্কিত যে কক্ষটি রয়েছে তা দেখলে মনে হবে যুদ্ধ কবলিত কোন এলাকা। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাজার হাজার ফাইল। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের করার কিছু নেই। উচ্চতর মহলকে বলার পরেও কোন কাজ হয়নি।

আর শিক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ার পর বিভিন্ন পদ-পদবির লোভে ভিসি অফিস বা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখাকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আর ভিসি মহোদয় স্যার ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন বিভাগের নবীনবরণ, ফিতা কাটা বা সভা-সেমিনার নিয়ে। এসব কাজের জন্য বিভাগীয় প্রধান বা সর্বোচ্চ ডিনরাই যথেষ্ট। একজন বিশ্ববিদালয়ের ভিসির কাজ হবে পলিসি নিয়ে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হাজার বছর পিছিয়ে আছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। কিসের ভিত্তিতে একে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয় তা বোধগম্য নয়। শিক্ষার মান নিয়ে কথা বললে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারে-কাছেও নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। করোনা মহামারিতে বিশ্ব এখন নিথর, নিস্তব্ধ। মানুষ দিশেহারা। জীবন যেন থেমে গেছে। মানুষকে আবার এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। করোনার টিকা আবিষ্কারে নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন স্থান নেই।

সমালোচনা যাই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে তার আপন গতিতে। এটাই আমরা বিশ্বাস করতে চাই। জাতি গঠনে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতার ভূমিকায় থাকবে। গণতন্ত্র বিকাশে এগিয়ে আসবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। এদেশের বর্তমান ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে এগিয়ে আসবেন এ বিশ্ববিদ‌্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা। সকল অনিয়ম-অবিচারের বিরুদ্ধে আবারও মাঝপথে দেখতে চাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক সবার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এসব প্রত্যাশা আমার একার নয়, পুরো দেশবাসীর, বাঙালি জাতির।


সর্বশেষ সংবাদ