চীন-ভারত দ্বন্দ্ব: বাংলাদেশ তুমি কার?

ফাহাদ হোসেন হৃদয়
ফাহাদ হোসেন হৃদয়  © টিডিসি ফটো

এক,

এশিয়ার দুই পরাশক্তি চীন ও ভারত একে-অপরে বর্তমানে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন সেনা হতাহতের পর লাদাখ সীমান্তের দু’পক্ষের মধ্যে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সামরিক উত্তেজনা হঠাৎ করে তৈরি করেছে।

১৯৬২ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে বড় ধরনের প্রথাগত সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে চীন অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীন অঞ্চল ভারতের কাছ থেকে দখল করে নেয়। পরবর্তীতে অরুণাচল প্রদেশের দখল ভারতের কাছে ছেড়ে দিলেও চীন আকসাই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। পরবর্তী সময়ে এ দুই অঞ্চলকে নিজেদের এলাকা হিসাবে দাবী করে আসছে দু’দেশ।

দুই

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকায় দু’দেশই তাদের সেনা সমাবেশ বৃদ্ধি করেছে। দু’পক্ষই বলছে, অন্যপক্ষের সেনাবাহিনী সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে তাদের ভূমি দখলের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি সেসব ভূমিতে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ করছে। ফলশ্রুতিতে দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতি যে ঘোলাটে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভারতের সেনা সদস্য নিহতের কথা স্বীকার করলেও চীন কিন্তু তাদের কোন সেনা সদস্যের হতাহতের খবর নিশ্চিত করেনি।

অন্যদিকে, ভারতীয় মিডিয়াতে চীন ও ভারত সীমান্ত দ্বন্দ্ব যতোটা গুরুত্ব পেয়েছে; তার তুলনায় চীনা মিডিয়াতে বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন আলোচানাই হয়নি। এদিকে চীন ভারতের নিকট প্রতিবেশীদের সাথে নিজেদের সম্পর্ক বৃদ্ধি করে ভারতকে একঘরে করার কূটনৈতিক নীতি অনুসরণ করছে। ফলশ্রুতিতে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন প্রশ্ন।

ক) আসলেই কি এশিয়ার দুই পরাশক্তি একে-অপরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে?
খ) এটা কি শুধুই সীমান্ত বিরোধ নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অন্য রহস্য?
গ) যদি সত্যি দুই-দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তবে কে কাকে তার পাশে পাবে?
ঘ) বাংলাদেশ কার পক্ষে অবলম্বন করবে যদি দুইদেশের বিরোধ আরো ঘনীভূত হয়?

তিন

প্রকৃতপক্ষে, দুই দেশই বর্তমানে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাইবে না। যুদ্ধ হলে দুই দেশেরই যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ, দুই দেশই পারমাণবিক ও আধুনিক অস্ত্রে শক্তিশালী। কোন পক্ষই চাইবে না নিজেদের ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসতে।

অন্যদিকে, ভারতের অর্থনীতি অবস্থা বিগত কয়েক বছর ধরে খুব একটা ভালো নেই। ভারতের অর্থনৈতিক সংকটকে আরো বৃদ্ধি করেছে করোনা পরিস্থিতি। পাশাপাশি, ভারত ও চীনের মধ্যে রয়েছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। যদি কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয় দুই দেশের মধ্যে; সেক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতি সম্মুখীন হবে ভারতের অর্থনীতি। আবার চীনও চাইবে না ভারতের মতো বিশাল রপ্তানি বাজার নষ্ট করতে। ফলে দুই দেশের মধ্যে সমস্যা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা থাকবে তাদের।

কিন্তু, আমরা যদি ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের দিকে লক্ষ্য করি, সে যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এমন সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে।

চার,

পৃথিবীর প্রত্যকটি দেশের সামরিক বাহিনীর কর্মকান্ডের পেছনে সে দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের মদদ থাকে। ভারত ও চীন উভয়ই অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে এশিয়াতে পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোবসাগরের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের বিরোধ। তিব্বত ইস্যুতে ভারত চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান থাকায় চীনা কতৃপক্ষ দীর্ঘদিন থেকে ভারত সরকারের প্রতি নাখোশ।

অন্যদিকে, ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করায় ভারত সরকারও চীনের প্রতি নাখোশ। আবার ক্রমাগত ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতপন্থী ব্লক থেকে বেরিয়ে এসে চীনপন্থী ব্লকে যোগ দেওয়ায় বেশ প্রশ্নবিদ্ধ ও সংকটে পড়েছে মোদি সরকারের কূটনৈতিক নীতি। ভারতকে আরো চাপে ফেলে দক্ষিণ এশিয়া ও বঙ্গোপসাগরের একক নিয়ন্ত্রণ নিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে চীন।

সম্প্রতি নেপাল, ভারতের সাথে তাদের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোকে নিজেদের এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করছে। ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্রের এমন সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত পুরো ভারত। ভারতীয় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, ‘চীনের পরোক্ষ সহায়তায় নেপালের এমন পদক্ষেপ’।

পাঁচ

১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ভারত তার কূটনৈতিক ও সামরিক মিত্রতার হাত ইউরোপীয় দেশগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সম্প্রসারিত করে। বাস্তবিকপক্ষে, চীন ও ভারতের কূটনৈতিক ও সামরিক মিত্রদের অবস্থান বিশ্ব রাজনীতির দুই মেরুতে। চীনকে রুখতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো একজোটে ভারতকে সাহায্য করতে পারে।

অন্যদিকে কার্যত, চীনের সেরকম কোন মিত্রজোট না থাকলেও ইরান ও পাকিস্তানের সাথে রয়েছে পরীক্ষিত বন্ধুত্ব। জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইসরায়েলের মতো চীন বিরোধী দেশগুলো ভারতকে কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে সাহায্য করতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে তাকালে হয়তো ভারতের মিত্রদের পাল্লা ভারী কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মিত্রদেশগুলো থেকে কতটুকু সাহায্য পাবে ভারত তা নিয়ে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক।

ভারতের মিত্রদেশগুলো বর্তমানে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যস্ত। দেশগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা। এ পরিস্থিতির মধ্যে ভারতকে সাহায্য করার মুহূর্তে দেশগুলো অবশ্যই নিজেদের স্বার্থ দেখবে আগে। অন্যদিকে চীন এক্ষেত্রে সফল। কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেও দেশটির অর্থনীতির চাকা অনেকটাই সচল বলা চলে। দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক পরিকল্পনার আলোকে দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সঙ্গে চীন গড়ে তুলেছে তাদের গভীর কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক। চীন ও ভারত দ্বন্দ্বে কার্যত দেশগুলো চীনকেই সমর্থন করছে। ফলশ্রুতিতে ভারতের চারদিকে এখন শুধু শত্রু দ্বারা ঘেরা।

ছয়

বাংলাদেশের ভূমিকা কি হতে পারে ভারত ও চীন দ্বন্দ্বে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ জটিল ভূ-রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বিবেচনা করে। বাংলাদেশের সাথে ভারত ও চীনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কূটনৈতিক, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক। কিন্তু চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে নিয়ে বলতে গেলে সম্পর্কটি সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক।

বাংলাদেশের সাথে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে চীনের সাথে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র আমদানির ক্ষেত্রে চীনের নির্ভরতা অনেক বেশি। চীনের পণ্যের বড় একটি বাজার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে চীনের অনুদান ও সহযোগিতা রয়েছে।

অন্যদিকে, আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলেও ভারতের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য সুবিধা আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। ভারতের কাছ থেকে সামরিক অস্ত্র ক্রয় করে না বাংলাদেশ। সেজন্য দুই দেশের সামরিক সম্পর্ক ভালো থাকলেও চীনের মতো ঘনিষ্ঠ নয়।

ভূ-রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশ যেখানে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সাথে সম্পর্ক তুলেছে, সেখানে এখনো বাংলাদেশকে তার নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসেবে পাচ্ছে। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া কতৃক বাংলাদেশকে "খয়রাতি" শব্দ ব্যবহার করা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। ফলশ্রুতিতে, বাংলাদেশ মতো দেশগুলো যাদের ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তাদের জন্য ভারত ও চীন দ্বন্দ্ব জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের এ পরিস্থিতিতে নিরেপক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ