আনন্দময়ীর আগমন

ইরফান রিয়াদ
ইরফান রিয়াদ  © ফাইল ফটো

রাজ রোষানলে পড়ে পৃথিবীর কত মহামানবদের যে বিনা কারণে শাস্তি পেতে হয়েছে তার হিসাব নেই। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লেখকের মৃত্যু কার্যকরের পর প্রমাণ হয়েছে তাঁর মতই ঠিক ছিল। এমন ঘটনাও ঘটেছে অহরহ। রচনা ফিরে পেলেও লেখককে আর ফিরে পাওয়া যায়নি। জগত্খ্যাত লেখক দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি, ভলতেয়ার, মিলটন, তলস্তয়, ডারউইন, পাবলো নেরুদা, বরিস পাস্তর,সলঝিনিত এর মত প্রমুখ মহাপুরুষ যুগে যুগে রাজরোষে কবলিত হয়ে নিপীড়ন নির্যাতন ভোগ করেছেন। নিক্ষিপ্ত হয়েছেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে।

রোমান নৃপতি টাইবেরিয়ান তাঁর কাজের সমালোচনা করায় ইতিহাসবিদ কসডাসকে কারাপ্রকোষ্ঠে অভুক্ত রেখে তিলে তিলে হত্যা করেন। চতুর্থ লুই লেখক বোমারসের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে কারাগরে নিক্ষেপ করেন। টমাস পেইন তাঁর বই ‘মানুষের অধিকার’ শীর্ষক গ্রন্থের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কারের জন্য রোজার বেকন দশ বছর কারাগারে বন্দি ছিলেন। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পর হেমলক নামক বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে বলেছিলেন—‘I to die, you to live, which is better only GOD knows’। গ্যালিলিও কেও ধর্মান্ধ ধর্মজাযকদের ভয়ে তার সঠিক মতবাদ পাল্টাতে হয়েছিল। বার বার সতর্ক করে দিয়েও মত না পাল্টানোর জন্য গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে প্রকাশ্যে পথে গির্জার যাজকরা সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে ছিঁড়ে মেরে ফেলেন।

আমাদের উপমহাদেশও এমন বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন বারবার। ব্রিটিশ শাসনামলে, রাজশক্তি ব্রিটিশদের নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রন্থ রচনার জন্য বহু ভারতীয় লেখকের রচনা বাজেয়াপ্ত করেছিল ব্রিটিশ সরকার। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-বালগঙ্গাধর তিলক, কবি মুকুন্দ দাস, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, সখারাম, গনেশ দেউস্কর, গিরিশ চন্দ্র, সৈয়দ আবু মুহম্মদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানবেন্দ্রনাথ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, সৌমেন ঠাকুর, সোমনাথ লাহিড়ী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ। আবার বাজেয়াপ্ত না হলেও ইংরেজ সরকারের নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন লেখকের সংখ্যাও কম নয়।বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ, সধবার একাদশী, নবীচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ, প্রবাসের পথে, স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলী, অরবিন্দের ভবানীমন্দির, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মেবার পতন ও রানা প্রতাপ, রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি প্রমুখ লেখকের লেখনির জন্য ব্রিটিশ সরকারের মিথ্যা মামলা অথবা হয়রানির শিকার হতে হয়।

তবে ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে বেশি রোষানলে পড়তে হয়েছিল নজরুলকে। নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সেনাবাহিনীর সৈনিক। অন্যায়ের বিপক্ষে, সত্যের পক্ষে ও শোষিত মানুষের জন্য কথা বলতে গিয়ে নজরুল ব্রিটিশ শাসকের রোষানলে পড়ে জেল পর্যন্ত খেটেছেন। শুধু তাই নয়, নজরুলের লেখার ওপর বারবার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। নজরুলের যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি। তাই নজরুলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজরোষের মাত্রা কতটা ছিল তা এখান থেকেই অনুমান করা যায়। ১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন।

ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি রচনা করেন প্রলয়ংকরী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’।কবিতার কিছু লাইন ছিল এমন-

‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী।’

তাঁর এই কবিতা প্রকাশের পর ব্রিটিশ সরকারের ভীত পর্যন্ত কেপে যায়।নজরুলের লেখনি বাজেয়াপ্ত করার লক্ষ্যে সরকার তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি মুক্তির জন্য যুক্তির উক্তি দিয়ে এক জ্বালাময়ী অভিভাষণ প্রদান করেন নজরুল। সেই দীপ্তিময় উচ্চারণই পরিবর্তী সময়ে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে সাহিত্যের রুপালি পাতায় সোনালি অধ্যায় হিসেবে স্থান করে নেয়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার তাকে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। কিন্তু ব্রিটিশরা নজরুলের বাঁশি কেড়ে নিলেও বাঁশির মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। কারণ বাঁশির সুর ছিল তার প্রাণে। তাঁর সুর যে তিনি ততোদিনে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের প্রাণে তৈরি করে দিয়েছিলেন।

আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে নজরুল ছিলেন বিশেষ শ্রেণির কয়েদি। কিন্তু হুগলিতে স্থানান্তরের পর নজরুলকে বিশেষ শ্রেণির কয়েদির মর্যাদার পরিবর্তে সাধারণ শ্রেণির কয়েদির অবস্থানে নামিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় নজরুল রচনা করেন জ্বালাময়ী ‘শিকল পরার গান’। জেলখানার ভিতর অকথ্য নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়ে নজরুল এখানেও বিদ্রোহী হয়ে শুরু করলেন আন্দোলন। আন্দোলনের সূত্র ছিলো জেলখানায় পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি, ভাতের বদলে মাড় ভাত ও রাজবন্দীদের নির্যাতনের প্রতিবাদ। এসব বন্ধের দাবিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। একটানা ৩৯ দিন অনশন করে যান নজরুল। সেই সময় স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে চিঠি লিখে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে টেলিগ্রামে নজরুলকে অনুরোধ করেন- ‘Live up hunger strike. Our Literature claims you.’ কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ 'wrong address' লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠায়। জেল কর্তৃপক্ষ প্রকৃত ঠিকানা জানলেও ইচ্ছা করেই টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে না পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফেরত পাঠায়।

রবীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় দারুণ মর্মাহত হন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নজরুলের অনশনের খবর শুনে জেলে গিয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে জেল কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে দেখা করতে পারেননি। ফলে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি হতাশ হতে হয়েছিল তাকে। চুরুলিয়া থেকে নজরুলের মা জাহেদা খাতুনও নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হন। এসব সংবাদ খুব দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।শেষ পর্যন্ত অনশনের ৩৯ দিন পর কুমিল্লার বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন।

বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। ইসলামী সঙ্গীত তথা গজলের সৃষ্টি তাঁরই হাত ধরে।যেই গান না শুনলে বাঙালির ঈদ পরিপূর্ণ হয় না ‘ও মোর রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এই গানের স্রষ্টাও নজরুল।এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন।

নজরুল যখন আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে সময় তাঁর সদ্য রচিত ‘বসন্ত’ নাটক নজরুলকে উত্সর্গ করেন। ‘বসন্ত’ নজরুলকে আলীপুর জেলে পৌঁছে দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে জোড়াসাঁকোয় ডেকে বলেন, ‘‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল।তাকে বলো, আমি নিজের হাতে তাকে বইখানা দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’’

সেদিন জেলখানার ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডার বিস্মিত হয়েছিলেন যে ঠাকুর ঐ প্রিজনারকে বই ডেডিকেট করেছেন শুনে। আর নজরুল ‘বসন্ত’ বই তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরেছিলেন।

‘ব’ দিয়ে যতগুলো বিশেষণ বিচিত্র্য, বীর, ব্যতিক্রম, বিষ্ময়কর, বর্ণিল, বিদ্রোহী সবগুলোই নজরুলের সাথে যায়। সাহিত্যের যে কোন ব্যক্তির সাথে এসব প্রত্যয় যোগ বিয়োগ করে দেখলেও কখনো সবগুলো তাঁর সাথে মিলবে না। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে নজরুল বিচরণ করেননি।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট কবি ইহলোক ত্যাগ করেন। নজরুল তার শেষ ইচ্ছা স্বরুপ একটি গানে বলেছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’ কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। এই মহাপুরুষের জানাজা শেষে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকামণ্ডিত কবির মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান। কবির মহাপ্রয়ানে বাংলাদেশে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক এবং ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

আজ কবির জন্মদিবসে অগ্নিপুরুষ নজরুলকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: ইন্সটিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন, সিলেট 


সর্বশেষ সংবাদ