প্রায় প্রতিদিন দেখি মায়ের ব্রিফিং

করোনার অনলাইন ব্রিফিং
করোনার অনলাইন ব্রিফিং  © ফাইল ফটো

এ মাসের প্রথম দিনই আমার দেশে ফেরার কথা ছিল। দিনক্ষণ ঠিক করে বিমান-টিকিটও কেটেছিলাম। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকল। উড়োজাহাজ কর্তৃপক্ষ জানাল, সুইডেন থেকে বাংলাদেশগামী তাদের ফ্লাইটটি বাতিল করা হয়েছে।

বাতিলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর সংকটে পড়লাম। যে বাসায় ভাড়া থাকি, সেটার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে নতুন বাসা পাওয়া কঠিন। পরিচিত মানুষ ছিল বলে একটি বাসা পেলাম। দুই মাসের জন্য সেখানেই আছি।

আমার মন পড়ে আছে দেশে। আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। মা অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন)। এখন মহাপরিচালক ছুটিতে আছেন। তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন মা। করোনাবিষয়ক রোজকার সংবাদ ব্রিফিংও করছেন তিনি। প্রায় প্রতিদিনই মায়ের ব্রিফিং অনলাইনে দেখি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁর বক্তব্যও দেখা ও শোনা হয়। মা এত চাপের মধ্যেও প্রতিদিন আমার খোঁজ নেন। কী খেলাম, কী রান্না করলাম—সবই তাঁর জানা চাই।

মা-বাবাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা হয়। বাবা গত বছর অবসরে গেছেন। বাসাতেই থাকেন। মায়ের কাঁধে অনেক দায়িত্ব, তিনি সেই সকালে বেরিয়ে যান, ফেরেন রাতে। কত মানুষের সংস্পর্শে তাঁকে আসতে হয়। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অসুস্থ হলেন। তাই আরও বেশি চিন্তা হচ্ছে তাঁদের নিয়ে।


আমি সুইডেনের ইয়াভলা শহরে থাকি। ইয়াভলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে মাস্টার্স করছিলাম। শীতের সময়টায় পাশের শহর বোরলেংগায় ছিলাম। সেখানকার একটি স্কি-রিসোর্টে খণ্ডকালীন চাকরি করতাম। ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত কাজের কথা ছিল। করোনা-পরিস্থিতির কারণে তিন সপ্তাহ আগেই বন্ধ হয়ে যায়। এখন ইয়াভলা শহরে বাসায় বসে থেকে দিন কাটাচ্ছি। জমানো টাকায় চলছি। দেশে ফিরব বলে নতুন কোনো চাকরিতে যোগদানের চেষ্টাও করিনি।


অনেকের জানা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেলেও সুইডেনে স্বাভাবিক অবস্থা। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সিংহভাগ রাজধানী স্টকহোমের বাসিন্দা। আমাদের দিকটা জীবনযাপন স্বাভাবিক। প্রশাসনের কড়াকড়ি নেই, লকডাউন করা হয়নি। শুরুতে সুইডিশ সরকার ৫০ জনের বেশি মানুষ একসঙ্গে জমায়েত হওয়া এবং বৃদ্ধনিবাসে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দেশটির নাগরিকদের এই সিদ্ধান্তে সমর্থন আছে। জনসাধারণ সবাই সচেতন। নিজেদের মতো করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। তা ছাড়া এখানকার অধিকাংশ মানুষ একা বাসায় থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক দূরত্ব বা বিচ্ছিন্নতার কাজটি হয়ে যায়।

স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ হিসেবে আমার দিন কাটছে নিয়ম মেনে। রান্নাবান্না করি, ব্যায়ামাগারে যাই, সপ্তাহের দু-এক দিন কাটে বন্ধুদের সঙ্গে। তবে কিছু পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। আমি বিভিন্ন ফিটনেস প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। গত ডিসেম্বরে ‘ফিটনেস ফেস্টিভ্যাল-২০১৯’ নামে শরীর গঠন ও অঙ্গসৌষ্ঠব প্রদর্শন প্রতিযোগিতার একটি বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। কিন্তু এখন তো সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

রোমাঞ্চের টানে এক সপ্তাহের জন্য একবার শুধু অবকাশে বেড়িয়েছিলাম। সুইডেনের উত্তরের রাজ্য কিরুনায় কাটিয়ে এলাম দিনগুলো। বরফের দুনিয়ায় রোমাঞ্চকর স্কি করার আনন্দ, দারুণ সময় কাটল। কিন্তু বাসায় ফিরতেই আবার মাথায় চাপল, কবে ফিরব দেশে?

এমিরেটস এয়ারলাইনসে খোঁজ করে দেখলাম আমার ফ্লাইটটি ২ জুলাই হওয়ার কথা। সুইডেন পরিচ্ছন্ন দেশ। এখানে জীবন সুন্দর। চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায়। অনেকের জন্য কাঙ্ক্ষিত জীবন এটা। কিন্তু আমি দিন শেষে এখানে একা। তাই দ্রুত দেশে ফিরতে চাই। আশা করি সব স্বাভাবিক হবে। আমিও ফিরতে পারব প্রিয় মাতৃভূমিতে, মা-বাবার কাছে। (সূত্র: প্রথম আলো)

লেখক: শিক্ষার্থী, ইয়াভলা বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন


সর্বশেষ সংবাদ