ঢাবির হল জীবন পর্ব-১

ভাইরে কি ‘ধইঞ্চা’ মনে হয়?

মারুফ হোসাইন
মারুফ হোসাইন  © ফাইল ফটো

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হলের পলিটিক্যাল বড় ভাইদের একটা কমন ডায়ালগ ছিলো এরকম— ভাইরে কি ‘ধইঞ্চা’ মনে হয়? সাধারণত গেস্ট রুমের অতিপরিচিত শব্দগুলোর মধ্যে ‘ধইঞ্চা’ কিংবা ‘ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া’ বা ‘তোরা হলের কুকুর বাদে সবাইকে সালাম দিবি’ অথবা ‘তোর তো চলাফেরা হয় না’ ইত্যাদি বাক্যগুলো এখনো কানে বাজে। রাত দশটার গেস্টরুমে ফাঁপর খেতে খেতে আমরা পলিটিক্যাল বড় ভাইদের সকল কথায় ‘জ্বি ভাই’ বলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই এক রাতের গেস্টরুমে বড় ভাইগুলো যখন সোফায় বসে অকারণে মোবাইলের বাটনগুলো চাপতে চাপতে আমাদেরকে ধমকাইলেন এই বলে— এই ভাইদেরকে কী তোরা ‘ধইঞ্চা’ মনে করিস? তখন আমরা চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী সবাই সমস্বরে বলে উঠলাম ‘জ্বি ভাই’। তারপর আমাদের পরিণতি কী হয়েছিল সে কথা পরে আর একদিন বলব।

সালটা ২০১১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর মাদ্রাসা ছাত্রদের একটা রিটের কারণে আমাদের ভর্তি কার্যক্রম পিছিয়ে গেলো তিনমাস। যথেষ্ট চড়াই উৎরাই পার করে ভর্তি হলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। যথারীতি হলে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলাম। ভর্তির কার্যক্রমগুলো শেষ করেছিলাম মহসীন হলের বড় ভাই ওবায়দুলের রুমে টানা দশ দিন থেকে। ভাইয়ের প্রতি তাই আজীবন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। যাহোক, এক রাতে ওবায়দুর ভাইকে কিছু না জানিয়ে আমার জন্য বরাদ্দকৃত হল মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে উঠতে গেলাম সূর্যসেন হলের আরেক বড় ভাই টিটো (দুলাভাই) ভাইয়ের হাত ধরে জিয়া হলের বড় ভাই মিলন ভাইয়ের আপ্রাণ চেষ্টার মাধ্যমে। মিলন ভাই আমাকে রাত নয়টায় উনার রুমে ডেকে ছাত্রলীগের এক বড় ভাই আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র হ্যাংলা পাতলা কিন্তু চরম ফাঁপরবাজ আলামিন ভাইয়ের হাতে আমাকে সোপর্দ করলেন।

আলামিন ভাই আমাকে অনেকটা কলার ধরা টাইপের ধরে ২০৮ এ ঢুকালেন। সেখানে আগে থেকেই কিছু পলিটিক্যাল বড় ভাই সিগারেট টানছিলেন তাদের মধ্যে শুধু রঞ্জু ভাইয়ের কথা মনে পড়ে বাকিদের কথা মনে নেই। কিছুক্ষণ পর আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হল। এইখানে সাধারণ পাঠকদের জন্য বলে রাখা ভালো, হলে রাতের গেস্টরুম মানে সেখানে ছাত্রদের নিয়ে চা, বিস্কুট খাওয়ানো হয় এমন যারা ভাবছেন তারা বড় ভুলই করছেন। বরং সেখানে হলের নতুন ছাত্রদের রাত দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রেখে রাজনৈতিক তালিমের নামে অনেকটা জুলুম, অত্যাচার করা হয়। যদিও হল লাইফে এই জুলুম, অত্যাচারের একটা পজিটিভ ইফেক্ট থাকে সেটা পরবর্তীতে বোঝা যায়।

ফিরে আসি আমার প্রথম গেস্টরুম পারফরম্যান্সে। গেস্টরুমে ঢুকেই আমি প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গেলাম। সেখানে সোফায় গাদাগাদি করে কিছু বড় ভাই বসেছেন। তাদের প্রায় সবার হাতে স্মার্ট ফোন আর সিগারেট। দেখে বোঝা যাচ্ছে এরা অকারণে ফোন টিপছে আর সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। এদেরকে ঘিরে আমার ইয়ারের প্রায় শ খানেক ছাত্র গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়ানোদের সবার চোখেমুখে একটা অজানা, অদ্ভুত ভীতি স্পষ্ট। আমাকে এবার সবার সামনে বড় ভাইদের দিকে মুখ রেখে দাঁড়াতে বলা হল। দাঁড়িয়ে গেলাম। এবার পলিটিক্যাল ভাইদের প্রশ্ন শুরু হল— 
তোর বাড়ি কই?
- ভাই যশোর ।
ভাই যশোর মানে, বল যশোর।
- জ্বি ভাই যশোর।
পাশ থেকে একজন ধমকাইলেন ‘বানচো... ভাই যশোর না বল শুধু যশোর।
- আমি চুপ।
ওনারা আবার বলিলেন, ‘এই কথা বলিসনে কেন?’
এবার আমার চোখে পানি চলে এলো। আমি কাঁদছি।
কে একজন বলে উঠল ‘এই বানচো... কাঁদিস কেনো?
আমি চুপ।
এরই মাঝে কখন নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়েছি জানি না। বড় ভাইদের সামনে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়াতে নেই সেটা আমার জানা ছিলো না। হঠাৎ এক বড় ভাই হুংকার ছেড়ে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলিলেন, ‘বাইন... পকেটে হাত কেন?’

এবার পকেট থেকে হাত নামিয়ে হাত দুটো ঝুলিয়ে রাখলাম। আবার একজন বলিলেন হাত ঝুলালি কেনো? হাত উপরে তোল। তুললাম উপরে। আবার একজন মারতে এলো। শেষে মনে মনে বলতে লাগলাম, আল্লাহ তুমি যারে ঢাবিতে চান্স দিবা তার যেনো হাত দিও না, গেস্টরুমে এই হাত রাখার তো কোনো জায়গা দাওনি তুমি!’ চোখ থেকে অঝরে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে আমার আর আমি হাত রাখা নিয়ে মহাবিপদে পড়েছি সেটা ভেবে হাত দুটোর উপর আমার চরম রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে আসার সময় যদি হাত দুটো এক্সিডেন্টে ভেঙে যেত তবেই বোধহয় সবচেয়ে ভালো হত। এরই মধ্যে আবার প্রশ্ন হলো-
মাদ্রাসায় পড়েছিস?
- না ভাই।
শিবির করিস?
- না ভাই।
আবার গালি।
চুপ থাকলাম।

এইবার আমাকে দেওয়ালে টাঙানো একটা ঘড়ির দিকে তাকাতে বলা হল। তাকালাম সেদিকে। ইতোমধ্যে মানসিকভাবে এতটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছি যে সেই ঘড়িটা আর খুঁজে পাচ্ছি না। আবার গালি। ‘বাইন... ঘড়ি চিনস না?’
-চিনি ভাই।
এতো কথা বলিস কেন?
চুপ থাকতে পারিস না?
আমি চুপ।

‘যা পিছনে গিয়ে দাঁড়া। হলে কুকুরবাদে সবাইকে সালাম দিবি।’

ভয়াবহ সেই ঘন্টাটা পার হল। রাত এগারোটায় গেস্ট রুম শেষ হল। এক দৌঁড়ে চলে গেলাম মলচত্বর। সেখানে দাঁড়িয়ে বাবাকে ফোন দিলাম। আব্বা আমি এখানে আর পড়ব না। আমি বাড়ি চলে আসব। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ল’তে চান্স পেয়েছি ওখানে পড়ব। অনেক কাঁদলাম ফোনে বাবার সাথে, বাবাও কাঁদলেন। তারপর বাবা বললেন তুই কোনো একটা মেসে চলে যা, যত টাকা লাগে আমি দেব। আমার আর মেসে যাওয়া হয়নি।

চলে এলাম মহসিন হলে ওবায়দুর ভাইয়ের রুমে। একা একা হলে উঠেছি শুনে ভাই সেদিন আমাকে অনেক বকেছিলেন।
চলবে...

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ