অদ্ভুত উটের পিঠে নির্বাচন কমিশন

মো. রাকিবুল ইসলাম
মো. রাকিবুল ইসলাম  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন নিয়ে কিছু লিখতে গেলে আমার মির্জা গালিবের একটি গজলের কথা মনে কথা মনে পড়ে ‘জাব তাক কহি উঠ গাই, কিউ কিসি কা গিলা কারে কোয়ি’ যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় সব আশাই যখন শেষ কেন আর কারো নামে মিছে অনুযোগ?

আসলেই প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ধীরে ধীরে সকল আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে। এতদিন নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে কিন্তু এখন বোধহয় সময় এসেছে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের বিবেচনাবোধ নিয়ে কথা বলার।

সারা পৃথিবী জুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থমকে গেছে। উন্নত দেশগুলো করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে, আর আমাদের নির্বাচন কমিশন উট পাখির নীতি মেনে চলছে বলে মনে হচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়ে যেখানে জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে; ইতালি, গ্রিস আমেরিকার, মত দেশ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। জনগণকে বাসায় থাকার পরামর্শ দিচ্ছে।

সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন স্থগিত করার বিষয়ে সরকারের নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে থাকা নির্বাচন কমিশনের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনসহ ঢাকা ১০ এবং আরো পাঁচটি আসনে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। করোনাভাইরাসের প্রস্তুতির জন্য সরকার যেখানে জনগণকে উৎসাহিত করছে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য সেই মুহূর্তে পত্রপত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মারফত দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন নির্বাচনে প্রার্থীরা।

এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনকে এ নিয়ে কোনো জোরালো নির্দেশনা দিতে দেখা যায়নি। আরো ভয়ের বিষয় হচ্ছে এই সমস্ত প্রার্থী দলে দলে তাদের সমর্থকদেরকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেছেন যেটা এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট সহায়ক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে বহু আগেই প্যানডেমিক অর্থাৎ বিশ্ব মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে অর্থাৎ সারা পৃথিবী জুড়েই করোনাভাইরাস এখন একটি মাথাব্যথার কারণ কিন্তু এতসব বৈশ্বিক ঘটনা শুধুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারছে না আমাদের নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ডে।

বাংলাদেশ সরকার জনগণকে উৎসাহিত করছে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হতে এবং এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সরকার ইতিমধ্যে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকারের এই পদক্ষেপকে যথেষ্ট সাধুবাদ জানাই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ঘুম কি ভাঙবে?

গতকাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পেছানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এই পরিস্থিতিতেই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদেরকে নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন, জনসমাগম ঘটাচ্ছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, কোলাকুলি করছেন। একটা বারও কি ভেবে দেখেছে নির্বাচন কমিশন কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এর ফলে! ধরে নেই এই পরিস্থিতিতে যদি নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আয়োজন করে, সে ক্ষেত্রে আতঙ্কিত জনগণ কতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে?

তার চেয়েও বড় কথা বিগত নির্বাচনগুলোতে এমনিতেই ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল কম। এহেন পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন কতটা বিবেচনাপ্রসূত? নির্বাচন কমিশনের আয়োজনে যদি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঠিক সময় অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ভোটাররা ভোট গ্রহণের দিন ভোটকেন্দ্রে ভিড় জমাবে যেটা এই মুহূর্তে আত্মহত্যার শামিল। আবার ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহৃত হবে বলে কিছু ক্ষেত্রে একই জায়গায় অসংখ্য মানুষের হাতের স্পর্শ পড়ার সম্ভাবনা আছে।

এত বড় পরিসরে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত পরিবেশে নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আবার করোনা প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত যে নীতি অর্থাৎ এই মুহূর্তে জনসমাবেশ ও জনমানুষের মিলন থেকে বিরত রাখা, সেই নীতিবিরুদ্ধ কাজ হচ্ছে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে নির্বাচনে নির্বাচনী প্রার্থীদের প্রায়ই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করতে দেখা যায়। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন যদি জনসমাবেশ এড়িয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য প্রার্থীদের নির্দেশনা দেয় সে ক্ষেত্রে সেটা কতটা ফলপ্রসূ হবে, নির্বাচনী প্রার্থীরা সেটা কতটা মেনে চলবেন সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকে।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে জনগণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে নির্বাচন কমিশনের উচিত এই মুহূর্তে সকল ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে বাংলাদেশের জনগণ আরও দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান।

কেন নির্বাচন কমিশনকে সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হবে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য? আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারগণ আর তো পৃথিবীর বাইরের কেউ নন। তারা সকলেই বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত বলেই আমার বিশ্বাস।

তাহলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এত গড়িমসি কেন? যে চারটি উপাদান নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয় তার মধ্যে জনগণ একটি অর্থাৎ জনগণ রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য উপাদান। মহামারীতে দেশের কোন অঞ্চল যদি জনশূন্য হয়ে যায় তবে নির্বাচন দিয়ে কি করবেন? জনহীন ভূমি তো আর রাষ্ট্র গঠন করতে পারে না। তাই রাষ্ট্রকাঠামোতে জনগণের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কেন যেন আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিবেচনায় জনগণের গুরুত্ব অনেক পরে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড তাই প্রমাণ করে চলেছে।

এই মুহূর্তে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সকল ধরনের নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হোক। বিগত বছরগুলোতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড বারবার প্রমাণ করেছে নির্বাচন কমিশন বর্তমানে একটি জনবিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন গুলো সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় প্রদান করে।

করোনার প্রাদুর্ভাব রোধে জনস্বাস্থ্য নিরাপদ রেখে নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালনা সংক্রান্ত শুধুমাত্র একটি নির্দেশনা জারি করে সংস্থাটি দায় এড়াতে চাচ্ছে। নির্বাচনকালীন সময়ে শুধুমাত্র বিদেশ ফেরত ভোটারদেরকে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা জারি করে দায়সারা দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হবে।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সঠিক সময়ে জনগণের স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যর্থতার জন্য জনগণ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কি দায় এড়াতে পারবে? তাই এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য নির্বাচন স্থগিত করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কর্তাব্যক্তিদের ঘুম ভেঙ্গে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক; অন্তত একটিবার জনগণের কথা চিন্তা করে হলেও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করুক এ প্রত্যাশা করছি।


লেখক- মোঃ রাকিবুল ইসলাম
প্রভাষক, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ