আমার মা উচ্চশিক্ষিত হলেও নিরক্ষর

  © ফাইল ফটো

আজ ৮ মার্চ। আমার মা উচ্চ শিক্ষিত হলেও নিরক্ষর। তিনি লিখতে পড়তে পারেন না। মাঝেমধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে স্বাক্ষর দরকার হলে খুব ইতস্তত হন। চেষ্টা করেন দিতে সেটা আর হয়ে উঠে না; অপরাধীর ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করেন। আমিও সহাস্যে টিপসই করতে বলি। অথচ তাঁর ছয় সন্তানের সবাই সাক্ষর এবং চার সন্তান বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেট প্রাপ্ত।

ছোট বেলা থেকে তিনি কখন ঘুম থেকে উঠেন, তা দেখার সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি আর দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাতেও তেমন দেখিনি। কারণ তাঁর অনেক দায়িত্ব : সন্তানেরা স্কুল থেকে আসবে তাদের খাওয়া, মুরগি-হাঁস-কবুতর আরও অনেক কিছু দেখাশোনার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে নিয়ে ঘুমাতে পারেন না।

রাতে আমি পড়তাম কাছারিতে। টেবিলের পাশেই ছিল একটি ছোট খাট, সেখানে বসে তিনি ঘুমাতেন। যদি বলি, মা ঘুমিয়ে পড়েন, তিনি বলতেন, ‘না, এমনি বসে আছি, তুই পড়, আমি শুনছি।’ আমারও আর পড়া শেষ হয় না, মাও ঘুমায় না। এভাবে চলতো আমাদের দিনগুলো প্রতিদিন প্রায় রাত একটা দুটো।

আমার মা অনেক সৃজনশীল, তিনি জানেন, কিভাবে ২ টাকাকে ১ টাকা করে ৩ জনের মধ্যে ভাগ করে দেয়া যায়।

আমার মা ভালো নেত্রী, তিনি জানেন, কিভাবে অভাবের সংসারে শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে সন্তানকে মানুষ করা যায়। আমার মা একজন ডাক্তার, তিনি জানেন, কিভাবে রোগ প্রতিরোধ করা যায় কিংবা অসুস্থ কে কিভাবে কম খরচে সুস্থ করা যায়।

কিন্তু আমরা মার কোন নাম নেই, কখনো কাউকে তাঁর নাম ধরে ডাকতে শুনিনি। কেউ ডাকে ওমুকের মা, কেউ বলে তমুকের বউ, কিংবা তমুকের মেয়ে।

আমার মার কোন সম্পদ নেই, তাঁর বাবা তাঁকে দোয়া করেছেন আর তাঁর ভাইকে অর্থ সম্পদ দিয়েছেন। আমার মার কোন দেন মোহর নেই, কারণ আমার সমাজ যৌতুক নগদ ধার্য করলেও মোহরানা বাকী করাকে শ্রেয়া মনে করেন।

আমার মার কোন স্বাধীনতা নেই। কখনো তিনি বাপ বা স্বামীর অধীন, কখনো তিনি সন্তানের করুণায় বেঁচে থাকবেন। আমার মার কোন কিছু কিনার অথবা বলার অধিকার নেই । কারণ তাঁর তো কোন আয় নেই যদিও তিনি ২৪\৭ অন ডিউটিতে থাকেন।

আপনি জানেন: আমার মার ঘর নেই। কখনো বাপের বাড়ি, কখনো স্বামীর আর ভালো না লাগলে ঝির বাসায়, এতো চলছে।

অবশ্য আমি যখন মাকে বলি, তোমার তো কোন নীড় নেই! তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘নীড় নেই তো কি হয়েছে, বিশাল আকাশ তো আছে’ এখন তিনি শুধু আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন আর ভাবেন। কেবল কি ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে প্রতীক্ষায় থাকেন তেপান্তরের।

আসলে সত্যি কথা কি, আমার মার কোন পরিচয় নেই কারণ তিনি যে নারী! হুম নারী নারী! নারীর কোন অধিকার থাকতে নেই।

প্রত্যেক নারীর মধ্যেই মাতৃত্ব থাকে। নারীর মায়া মমতা আর মাতৃত্বের জন্যই আজ ধরণী এত সুন্দর। নারী দিবসে প্রত্যেক নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। নারীর জন্য নিরাপদ পৃথিবীর প্রতীক্ষায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ