হকিংয়ের চেয়েও বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন জামাল নজরুল

জামাল নজরুল ইসলাম
জামাল নজরুল ইসলাম  © ফাইল ফটো

আমাদের দেশটা খুব ছোট। সুযোগ সুবিধাও খুব কম। এ সীমিত সুযোগ কাজে লাগিয়ে এদেশের মাটিতে জন্ম নিয়ে আলো বাতাসে বড় হয়ে খুব অল্প সংখ্যক বাঙালিই বিশ্ব গগনে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। বিশ্ব পরিমণ্ডলে তাঁদের কিঞ্চিত পরিচিত ও প্রসিদ্ধি থাকলেও নিজ দেশেই তারা অচেনা ও উপেক্ষিত। যাঁদের নাম ডাক অনেকটাই অনুচ্চারিত।

প্রতিদিনের খবরের পাতায় স্টিফেন হকিং, নিউটন, আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীদের নাম চাউর হলেও আমাদের কৃতি বিজ্ঞানীরা প্রচারণাবিহীন। আমাদের দেশে জন্ম নেয়া একজন বিজ্ঞানী ছিলেন স্টিফেন হকিংয়ের চেয়ে বড় মাপের বিজ্ঞানী। তাঁর বিশ্ব জয়ের খবর কতজনই বা জানে। তিনি হলেন আমাদের জামাল নজরুল ইসলাম। সারা বিশ্বে তিনি জেএন ইসলাম নামে পরিচিত এবং বিজ্ঞানীদের কাছে বাংলাদেশ জেএন ইসলামের দেশ হিসেবে পরিচিত। সারা বিশ্বে বিজ্ঞানী মহলে জেএন ইসলাম জিনিয়াস ইসলাম নামেও সমধিক পরিচিত ছিলেন।

জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন স্টিফেন হকিংয়ের রুমমেট এমনকি তার চেয়ে বড় মাপের বিজ্ঞানী। জেএন ইসলাম সম্পর্কে বলতে গিয়ে হকিং বলেছিলেন, ‘জেএন ইসলাম আমার রুমমেট, বন্ধু এবং আমরা ছিলাম পরস্পর পরস্পরের শিক্ষক। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হকিং যেসব বিজ্ঞানীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন, তন্মধ্যে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। হকিংকে বিংশ শতাব্দীর আইনস্টাইন বলা হলেও তিনি কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাননি। পদার্থবিদ্যার আবিষ্কার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণ করতে হয় কিন্তু হকিং কোনো বর্ণনা প্রমাণ করতে পারেননি।

অনেকে মনে করেন, হকিং যত না পরিচিত বিজ্ঞানী হিসেবে তার চেয়ে বেশি পরিচিত সায়েন্স ফিকশনের লেখক হিসেবে। হকিং মেধাবী ছিলেন নিঃসন্দেহে, তবে অসুস্থতা, অমুসলিম এবং ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী বেশি প্রচার পেয়েছেন। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম নিজ দেশ থেকেও এমন মূল্যায়ন পাননি।

প্রচার ছাড়া প্রসার কীভাবে হয়? বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জামাল নজরুল ইসলামের লেখা ‘কৃষ্ণবিবর’ গ্রন্থটি হকিংয়ের ব্ল্যাকহোল থিউরির অনেক আগেই প্রাচ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত। কিন্তু আমরা কেউ তা জানি না। জানলেও তা কেউ প্রচার করিনি। জেএন ইসলামের দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স’ লেখা হয়েছে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে কিন্তু হকিংয়ের ‘অ্যা ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম’ লেখা হয়েছে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে।

দুটি গ্রন্থ তুলনা করলে নিঃসন্দেহে জামাল নজরুল ইসলামের বইটি যেকোনো বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম নিয়ে আমরা যে তোলপাড় করেছি, জেএন ইসলামের আল্টিমেট ফেইট নিয়ে তার একটুও করেনি।

এটি সত্য বাংলাদেশের মাটিতে অল্প সংখ্যক বিজ্ঞানীই জন্মেছেন। নগণ্য সংখ্যক বিজ্ঞানীর মধ্যে সত্যেন বোস, জগদীশচন্দ্র বসু, মাকসুদুল আলমের মত নামকরা বিজ্ঞানী জন্মেছেন এদেশে। জন্মেছেন জামাল নজরুল ইসলামের মত মহান বিজ্ঞানী ও ব্যক্তিত্ব। যার সঙ্গে পরিচয় ছিল ডজন খানেক নোবেল জয়ী বন্ধু ও সুহৃদের। ফ্রেডরিক হয়েল, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন, স্টিফেন হকিং, প্রফেসর আব্দুস সালাম, রিচার্ড ফাইনমেন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

বয়সে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন হকিংয়ের সিনিয়র কিন্তু আবদুস সালাম এবং অমর্ত্য সেনের জুনিয়র। অমর্ত্য সেন ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে এলে বন্ধু জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করার জন্য চট্টগ্রাম চলে গিয়েছিলেন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম বাংলাদেশে এলে বিমান বন্দরে নেমেই বলেছিলেন, জে এন ইসলামকে খবর দিন।

ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত নারলিকা ছিলেন জামাল নজরুল ইসলামের সহপাঠী। রিচার্ড ফাইনম্যানের সাথে তাঁর ছিলো খুব ভালো সম্পর্ক। তাঁকে একটা মেক্সিকান নকশী কাঁথা উপহার দিয়েছিলেন ফাইনম্যান।

জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন একাধারে একজন পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ও বিশ্বতত্ত্ববিদ। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় তাকে নিয়ে এভাবে লেখা হয়নি, যেমনটি লেখা হয়েছে হকিংকে নিয়ে। বিজ্ঞানের জগতে ড. জামাল নজরুল ইসলামের অবদান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী ড. আব্দুস সালামের কথায়ই বোঝা যায় কিন্তু বাঙালিরা তাকে বুঝেনি।

ড. আব্দুস সালাম বলেছিলেন, এশিয়ার মধ্যে আমার পরে যদি দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নোবেল পুরস্কার পায়, তবে সে হবে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম। এই মাটির সন্তান বিজ্ঞানী জামাল নজরুলের বেড়ে উঠা ও বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী হওয়ার পেছনের গল্প অনেকের কাছেই অজানা। আজ এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর জন্মদিন। তাঁর জন্মদিনে এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে জানানোর অভিপ্রায়ে অধমের দুকলম লেখার ধৃষ্টতা। আমি জামাল নজরুল ইসলামের নাম প্রথম পেয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে। তখন তাঁকে এতোটা জানার সুযোগ হয়নি। তবে ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে অনেক জানার সুযোগ হয়েছিল।

যতটুকু জানা যায়, জামাল নজরুল ইসলাম ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ সালে ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তখন সে শহরের মুন্সেফ বা সময়ের বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য ছিলেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তাঁর বাবা কলিকাতায় বদলি হয়ে যান। জামাল নজরুল ইসলাম প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীতে শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়েন তিনি। পরবর্তীতে আবার মডেল স্কুলে ফিরে যান। জামাল নজরুলের ছেলেবেলা কাটে কলিকাতাতে। ৪র্থ শ্রেণী সম্পন্ন করে তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন ও পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। তবে এখানে একটা চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় তিনি চমৎকার কৃতিত্ব দেখান।

ফলে “ডাবল প্রমোশন” পেয়ে সরাসরি ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে পড়ালেখা করেন জামাল নজরুল ইসলাম। এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তাঁর অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। অনেক অতিরিক্ত জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। নবম শ্রেণীতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। এ সময় নিজে নিজে অনেক অঙ্ক কষতেন। বিভিন্ন বই থেকে সমস্যা নিয়ে সমাধানের চেষ্টাও করতেন যা পরবর্তীতে তাঁর অনেক কাজে আসে।

উল্লেখ্য, হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি একাই কেবল গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান। এখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের একজন শিক্ষককে জামাল নজরুল ইসলাম নিজের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

এই শিক্ষকের নাম ফাদার গোরে। গণিতের জটিল বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন বলেই জামাল নজরুল ইসলাম তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষক ফাদার সোরে জেএন ইসলামকে ডাকতেন জীবন্ত কম্পিউটার বলে।সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিএসসি শেষে ১৯৫৭ সালে জামাল নজরুল ইসলাম কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে আবারও স্নাতক ডিগ্রি (১৯৫৯) অর্জন করেন। ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি থেকে গণিতে ট্রাইপস পাস করতে লাগে তিন বছর। জেএন ইসলাম তা দুই বছরে শেষ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। কেমব্রিজ থেকেই মাস্টার্স (১৯৬০) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।

জামাল নজরুল ইসলামের কর্মজীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও চমকপ্রদ। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জামাল নজরুল ইসলাম কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিকাল অ্যাস্ট্রোনমিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন।

পাশ্চাত্যের উন্নত ৩০ বছরের অভ্যস্ত জীবন, লোভনীয় প্রস্তাব, সম্মানজনক পদ, গবেষণার অনুকূল পরিবেশ, বিশ্বমানের গুণীজন সাহচর্য এবং আর্থিকভাবে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ১৯৮৪ সালে ইসলাম বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। অতি দামি চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগ দিলেন মাসিক মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনে। অথচ কত বাঙালি উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে গিয়ে দেশে ফিরতে নারাজ।

চবিতে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক কোটা খালি না থাকায় তিনি গণিত বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা রিসার্স সেন্টার ফর ম্যাথম্যাটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে আগত খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী, আপেক্ষিকতত্ত্ববিদ এবং বিশ্ব সৃষ্টি তাত্ত্বিকদের অবদান স্মরণ করে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রফেসর ইসলামের শ্রেষ্ঠকীর্তি আখ্যা দেওয়া হতো। এখানে তিনি উচ্চতর গবেষণার ছাত্রদের সহায়তার পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছেন, যাতে অনেক নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পণ্ডিতজন যোগ দিতেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এই সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানটি আজ যথাযথভাবে ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

জামাল নজরুল ইসলামের সৃষ্টি কর্মের মধ্যে অনেক গবেষণা নিবন্ধ বিখ্যাত সব বিজ্ঞান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স (১৯৮৩) এই বই একটি মহলে বিশেষ সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়। জাপানি, ফরাসি, পর্তুগিজ ও যুগোশ্লাভ এবং বাঙালির একমাত্র বই যা হিব্র ভাষায় অনূদিত হয়। ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪), রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৫) বইটি আইনস্টাইন পরবর্তী মহাবিশ্ব গবেষণায় বিরাট অবদান রেখেছে। অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথম্যাটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২), কৃষ্ণ বিবর,মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ ,শিল্প সাহিত্য ও সমাজ ,স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ, দ্যা ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স।

জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক একজন দেশপ্রেমিক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তখন তিনি দেশে ছিলেন না। কিন্তু তাই বলে কি দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা কমেছে? না, একটুও কমেনি। তিনি তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখলেন যুদ্ধের বিস্তারিত জানিয়ে। যুদ্ধ বন্ধে সহায়তা করতে অনুরোধ করলেন। মানবতাবাদী শিক্ষার্থী হিতৈষী জামাল নজরুল ইসলাম নিজের আয় থেকে অর্থ জমিয়ে দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করতেন। তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেছেন।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁকে দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দেন। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে মানুষ মারা যায়। জামাল নজরুল ইসলাম বসে থাকেননি। তিনি তাঁর সাধ্যমত সাহায্য করেছিলেন হতাহতের পরিবারকে। ২০০১ সালে গুজব রটে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে তাড়াতাড়িই। কারণ হিসেবে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো জানায়, সৌরজগতের গ্রহগুলো এক সরলরেখা বরাবর চলে আসবে। সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে পৃথিবীর মানুষকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, সে রকম কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ একই সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবী নামক গ্রহের কোনো ক্ষতি হবে না।

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. জামাল অনেক উৎসাহ যুগিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, “অনেকের ধারণা, ভালো ইংরেজি না জানলে বিজ্ঞানচর্চা করা যাবে না। এটা ভুল ধারণা। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হতে পারে, উচ্চতর গবেষণা হতে পারে। বাংলায় বিজ্ঞানের অনেক ভালো বই আছে। আমি নিজেও অনেক প্রবন্ধ বাংলায় লিখেছি। অনেকেই বাংলাতে বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখছেন। তাঁদের সমস্যা হয় বলে আমার মনে হয় না। সুতরাং বাংলায় বিজ্ঞানচর্চাটা গুরুত্বপূর্ণ।”

প্রথিতযশা এই বিজ্ঞানী ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ৭৪ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। রেখে যান তাঁর অনবদ্য সৃজনশীল কর্ম।


সর্বশেষ সংবাদ