৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের জোহা স্যার

প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা
প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা  © সংগৃহীত

আজ ১৮ ফেব্রুয়ারি। আজকের এই দিনে স্বৈরাচার আইয়ুব শাহীর সেনার গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা।বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনালগ্নে ৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে আত্মদানকারী প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী তিনি। ডাকনাম জোহা, শিক্ষকজীবনেও ছাত্র ছাত্রীর কাছে ছিলেন প্রিয় জোহা স্যার।

ড. শামসুজ্জোহা ছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯-এরমধ্যে প্রথম শহীদ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমানের বাংলাদেশে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পাকিস্তানী বাহিনী ছাত্রনেতা আসাদকে হত্যা করে এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিহত হন।

তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নম্বর আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক ‘দেশরক্ষা আইনে’ ছাড়া পেলেও সামরিক আইনের গ্যাঁড়াকলে বন্দি ছিলেন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে। সেখানেই ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্মমভাবে নিরাপত্তা প্রহরীর গুলিতে শহীদ হন অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক।তাঁরা নিহত হলে তাঁদের হত্যার প্রতিবাদ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে, সান্ধ্যকালীন আইন জারি করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ১৯৬৬-এর ছয় দফা ও ১১ দফা দাবিতে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। সারাদেশের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। গণআন্দোলনে জোরদার হয় গোটা পূর্ব পাকিস্তানে।

এই হত্যার প্রতিবাদে ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার সমর্থনে ১১ দফা নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করে। ১৬ ফেব্রুয়ারির সেই হরতালে নির্লজ্জ সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।বাঙালিদের ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গে এই গুলি বর্ষণ যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো। যার ফলে ১৭ ফেব্রুয়ারিও সারাদেশ ছিল বিক্ষোভে উত্তাল।ঐদিন পুলিশি হামলায় বহু ছাত্র হতাহত হয়। রাজশাহীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা বেরিয়ে এলে সেখানেও চলে পুলিশের লাঠিচার্জ। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে চলাকালে পুলিশের হামলায় বহু ছাত্র আহত হয়। সেদিন সন্ধ্যায় রাবির কলাভবনে বাংলা বিভাগের এক অনুষ্ঠানে সকলের সামনে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত শার্ট দেখিয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ড. শামসুজ্জোহা বলেন, “আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত।ছাত্রদের সামনে দাঁড়ান। ‘ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার বুকে গুলি লাগে।এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে।পরের দিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল নয়টা বিভিন্ন হল থেকে প্রায় দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থী এসে জড়ো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে।

শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। স্থানীয় প্রশাসন ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আগের রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মূল ফটক থেকে মিছিল বের করার।আন্দোলনকারীদের দমন করতে সেদিন পুলিশ, ইপিআরের সাথে ছিল রাইফেল সজ্জিত সেনাসদস্যরাও। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সামরিক বাঁধা উপেক্ষা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ড. জোহা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।

সেদিন অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা থাকায় ড. জোহা সেনাসদস্যদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ।তিনি উত্তেজিত ছাত্রদের হলে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয় সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি না চালানোর অনুরোধ করেন।ড.জোহা বলেছিলেন, আমি আমি আমার সন্তানদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে ছাত্রদের বোঝাচ্ছিলেন ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং বার বার আশ্বাস দিচ্ছিলেন- “আমি বলছি গুলিবর্ষণ হবে না। আর যদি গুলি করা হয় তবে কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে।’’

তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করে বেলা ১১টার দিকে পাক হানাদার সেনা ক্যাপ্টেন হাদী পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটে পড়েন। গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে পরে রাজশাহী মিউনিসিপল অফিসে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তিনি আন্দোলনকামী জনতার বিজয় অনিবার্য করে তুলেছিলেন।যিনি নিজ ছাত্রদের রক্ষা করার জন্য বুকে বেয়নেট পেতে নিয়েছিলেন।ড. জোহা নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে তাঁর কথা রেখেছিলেন।

সত্যিই তিনি কথা রেখেছেন। ছাত্রদের উদ্দেশ্যে চালানো গুলি তিনি নিজ বুকে পেতে নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা ক্ষুব্ধ হয়ে শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল জাতির মহান এই অভিভাবককে। তাঁর মৃত্যু আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুতে সমগ্র দেশে বিক্ষোভের জোয়ার প্রবাহিত হয় এবং এর ফলে আইয়ুব সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয়।ড. শামসুজ্জোহা ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং একই বছর উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি রিডার পদে উন্নীত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক এবং ১৯৬৬ সালে প্রাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালের ১ মে থেকে মৃত্যু অবধি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব পালন করেন।৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ড. জোহা দেশের জনগণকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ছাত্রনেতা আসাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক শহীদ শামসুজ্জোহার মৃত্যু দেশেবাসীকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে।

শামসুজ্জোহাকে দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গন্য করা হয়। বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়ও তিনি প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।ড.জোহার মৃত্যু তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ভীতে কম্পন ধরে দিয়েছিল এবং প্রভাব ছিলো সূদূরপ্রসারী, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল। দেশের স্বাধীনতার পর তার অবদানের কৃতজ্ঞতাস্বরুপ তাঁকে শহীদ বুদ্ধিজীবির সম্মানে ভূষিত করা হয়। ড. জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার টাকা মূল্যের ডাকটিকেট চালু করা হয়। দেশের জন্য গৌরবময় ভূমিকা রাখায় তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ড.জোহার নামানুসারে একটি আবাসিক হলের নামকরণ করেন শহীদ শামসুজ্জোহা হল।২০০৮ সাল থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে রাবিতে পালন করা হয় জোহা দিবস হিসেবে, সে বছরই মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন এই মহাত্মা।২০১২ সালে শহীদ শামসুজ্জোহা হলের মূল ফটকের পাশে একটি স্মৃতি স্মারক স্ফুলিঙ্গ নির্মাণ করা হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসানিক ভবনের সামনে চোখে পড়বে ড. জোহার সমাধি। সেখানে জোহা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা করা হয়েছে। যা ‘জোহা চত্বর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।নাটোরে তাঁর নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ প্রতি বছর জোহা সিম্পজিয়াম পালন করে থাকে।

ড.জোহার মৃত্যুর ৩৯ বছর পর ২০০৮ সালে সরকার তাঁকে শুধু স্বাধীনতা পুরস্কার এবং তাঁর নামে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে দায় সেরেছে। একুশে পদক পর্যন্ত তাঁকে দেওয়া হয়নি। এজন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার আবেদন জানিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।প্রতি বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এই দিনটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে।

সম্প্রতি দেশের শিক্ষকসমাজ জোহার মৃত্যুদিবসকে ‘‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’’ হিসেবে পালনের দাবী জানিয়ে আসছে। এ দাবিটির ন্যায্যতা স্বীকার করলেও কার্যকরী পদক্ষেপ কেউই গ্রহণ করছে না।জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (United Nations Educational, Scientific, and Cultural Organization) বা ইউনেস্কো ১৯৯৪ সাল থেকে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করছে শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। বিশ্বের প্রায় ১০০টিরও বেশি দেশ আলাদাভাবে তাদের দেশে জাতীয় শিক্ষক দিবস পালন করে। আমাদের পাশের দেশ, ভারত তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ও শিক্ষাবীদ ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান-এর জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বরকে সে দেশে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে। যিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। এমন কী নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকায় র্পযন্ত স্বতন্ত্র শিক্ষক দিবস পালন করে তাদের শিক্ষকদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে থাকে।যিনি ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিলেন এমন ইতিহাস বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। সেই তরুণ উদীয়মান শিক্ষক শহিদ শামসুজ্জাহার ত্যাগকে স্মরণ করে ১৮ ফেব্রুয়ারি কি জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে আমরা পালন করতে পারি না? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে উদ্ভাসিত করবে বৈ অনুজ্জ্বল করবে না।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ