যে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নেপালকে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু আমরা?

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

আজ থেকে বছর তিনেক আগে ২০১৭ সালের কথা। ভারত নেপাল সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি) এর গুলিতে নিহত হন নেপালি যুবক গোবিন্দ গৌতম। ভারত নেপাল ১৭৫৮ কিলোমিটার সীমান্তে গোলাগুলি ও নিহতের ঘটনা বিরল।

এ ঘটনার পর গোটা নেপাল উত্তপ্ত হয়ে উঠে। নেপালি নাগরিকরা রাজধানী কাঠমান্ডুতে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ভারত সেই হত্যাকাণ্ডের কথা অস্বীকার করেছিল। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। নেপালি যুবক নিহত হবার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে দোভাল। এ ঘটনা তদন্তের জন্য দোভাল নেপালের সহযোগিতাও কামনা করেছিল।

কিন্তু বাংলাদেশ - ভারতের ৪,১৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমানায় এমন দৃশ্য কল্পনাতীত। প্রতিদিন লম্বা হচ্ছে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের নিহতদের তালিকা। বিশ্বের পঞ্চম দীর্ঘতম এই ভূমি সীমানায় চলতি বছরের প্রথম মাসে প্রথম ২৩ দিনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ বাংলাদেশি। সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি নওগাঁ ও যশোর সীমান্তে চার বাংলাদেশি খুন হন। তাদের মধ্যে তিনজন নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলিতে এবং একজন নির্যাতনে।

২০১৮ সালে সীমান্তে হত্যার পরিসংখ্যান কিছুটা স্বস্তির বার্তা দিয়েছিল বাংলাদেশিদের। ২০১৮ সালে সীমান্তে ৩ জন বাংলাদেশি নিহত হন। কিন্তু পরের বছর ২০১৯ সালে তা ১২ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ জনে। তবে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং অধিকার-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সংখ্যা যথাক্রমে ৪৬ এবং ৪১ জন।মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর নথিপত্রে আরও দেখা যায় ২০১৯ সালে বিএসএফের হাতে অন্তত ৪১ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছে এবং আরও ৩৪ জন অপহৃত হয়েছেন।বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত এলাকা দক্ষিণ এশিয়ার হত্যার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নিরস্ত্র এবং অসহায় স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরিষ্কার প্রমাণ সত্ত্বেও, এখন পর্যন্ত কাউকেই হত্যাকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি। হিউম্যান রাইটস্‌ ওয়াচের এশিয়া বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ব্যাড এডামস সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "Routinely shooting poor, unarmed villagers is not how the world's largest democracy should behave."

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩শ ১২ বার হামলা চালানো হয়। এতে ১২৪ জন বাংলাদেশী নিহত হয়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলায় ১৩ জন নিহত, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি ঘটনায় ৩৩ জন, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯ জন নিহত হয়।২০০১ সালে ৯৪ জন,২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন নিহত হন।

বিগত ১০ বছরে প্রায় ১,০০০ মানুষ ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক নিহত হন, যার বেশিরভাগই বাংলাদেশি।যদিও ২০১৯ সালে জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সংসদে জানিয়েছিলেন, বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে মোট ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হন। বছর ওয়ারি হিসাবে,২০০৯ সালে ৬৬ জন, ২০১০ সালে ৫৫ জন, ২০১১ ও ২০১২ সালে ২৪ জন করে, ২০১৩ সালে ১৮ জন, ২০১৪ সালে ২৪ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন, ২০১৬ সালে ২৫ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে ৩ জন মারা যান সীমান্তে।
বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের ঠাণ্ডা মাথায় খুনের একটিরও বিচার হয়নি। এমনকি বহুল আলোচিত ফেলানি হত্যার বিচার এখনো ঝুলে আছে।ভারতে একটি কার্যকরী আদালত থাকলেও, সীমান্তের এসব অপরাধের ক্ষেত্রে দৃশ্যত বিএসএফ একইসাথে বিচারক, জুরি এবং ঘাতক হিসাবে কাজ করতে পারে। যে কারণে সীমান্ত হত্যার বিচার পাওয়াটা দুষ্কর বটে।

ভারতের সাথে ৬টি দেশের স্থল সীমান্ত রয়েছে। এ দেশগুলো হল পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ। আর ভারতের সমুদ্র সীমান্ত রয়েছে শুধু শ্রীলঙ্কার সাথে। এই সবগুলো দেশের সীমান্তেই ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশের সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূণ্য। ওইসব সীমান্তে ভারতের সীমান্ত রক্ষী এতোটা মারমুখি ও বেপরোয়া অবস্থানে নেই। কিন্তু বন্ধু দাবিদার ভারতের বাংলাদেশের নাগরিকদের সীমান্তে পাখির মতো গুলি করে মারার প্রবণতা জনগণকে ভারত বিদ্বেষী করে তুলছে। এজন্য অনেকে সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও ভারত তোষণকে দায়ী করছেন।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা ভারতের সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের কারণে সীমান্ত জুড়ে কড়াকড়ি আরোপের কারণে এমন ঘটনা ঘটছে।সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত শ্যূট-অন-সাইট বা দেখামাত্র গুলি নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল আছে, যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করতে পারে।নেপালের মতো দুর্বল একটি দেশের জনগণ যদি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে তাহলে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনতার সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আপত্তি কোথায়? সরকার ও জনগণের শক্ত অবস্থান ভারতের এই আগ্রাসী নীতি রুদ্ধ করতে পারে। দেশের জনগণ সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের পর বিজিবির শুধু ফ্লাগ মিটিং দেখতে চায় না। চায় কড়া হুশিয়ার ও সীমান্তে জান মালের পূর্ণ নিরাপত্তা।


সর্বশেষ সংবাদ