আর কত বকুল ঝড়লে পরে, রক্ত গোলাপ ফুটবে?

শেখ তানভীর বারী হামিম
শেখ তানভীর বারী হামিম  © টিডিসি ফটো

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়”-শুনলে পরেই সাধারণ মানুষের কাছে ভেসে উঠে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র এর মহান স্বাধীনতা, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন কিংবা ২০০৭ সালের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণজাগরণ। কিন্তু ঠিক ক’দিন আগে এর বিপরীত চিত্রটা ভেসে উঠে - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের কাছে।

যে চিত্রটি চোখে ভেসে উঠে তা হলো গনরুম-গেস্টরুম কালচারের নামে নির্মম-নৃশংস শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং পরবর্তী সময়ে পুলিশের হাতে হস্তান্তর আর কখনো বা মৃত্যু।বর্তমান প্রেক্ষাপট এমনই যে - মরলে হয় শহীদ আর বেচে থাকলে ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির।

গতকাল রাতে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে শিবির সন্দেহে চারজন শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতন করে পরবর্তীতে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে হল ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। ব্যক্তিগতভাবে যদিও ছাত্র শিবিরের রাজনীতিকে আমি সমর্থন করিনা ও পছন্দ করিনা, কিন্তু কোন রকম নিশ্চিত না হয়ে শিবির সন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ শিক্ষার্থীকে নির্যাতন এটা কোনরকম মেনে নেয়া যায়না।আর যদি শিবির হয়েও থাকে এর জন্য হল ছাত্রলীগ হল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমে সমাধান করতে পারতো।এরকম স্পর্ধা বারংবার দেখিয়ে কোন রকম প্রতিক্রিয়া না হওয়ার ফলাফলই কি তবে এরকম নির্যাতন?

এই রাতভর শারীরিক নির্যাতন করে পরবর্তীতে পুলিশের হাতে সোপর্দ করার ঘটনা আজকে নতুন নয়।এইতো গতকিছু দিন আগে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দের সাথে ছবি থাকার কারণে ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিব ও ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী সুমনকে হল থেকে নির্যাতন করে বের করে দিয়েছিল এফ রহমান হল ছাত্রলীগ।যা দেশের প্রথম সারির সকল দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল।

১১ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল এ জাতীয় দৈনিক “দৈনিক সমকাল”-এ প্রকাশিত সংবাদ-‘ঢাবির ৯৭ ছাত্রকে হল থেকে বের করে দিল ছাত্রলীগ।’ ২১মার্চ ২০১৭ সাল এ জাতীয় দৈনিক “দৈনিক সমকাল”- এ প্রকাশিত সংবাদ -‘সাংবাদিকসহ ঢাবির হল থেকে ৫জনকে বের করে দিল ছাত্রলীগ।’ ২০ অক্টোবর ২০১৯ ক্যাম্পাসভিত্তিক জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল “দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসে” প্রকাশিত সংবাদ- ‘ঢাবির হলে ৭ বছরে নির্যাতনের শিকার ২৮২ শিক্ষার্থী’।এরকম হাজারো ঘটনা তথ্যসূত্রসহ দিলে লেখাটি কয়েক পৃষ্ঠা আরো ছাড়িয়ে যাবে ।

তবে কথার পিঠে একটি যুক্তি হলো- রাস্ট্রপতি মহোদয় সমাবর্তনে বলে গেলেন, ছাত্ররা লাশ হতে বা বহিষ্কার হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে না।তিনি যেহেতু নির্যাতনের ব্যাপারে কিছু বলেননি, তাই হলে গেস্টরুম নির্যাতন চলতে কোন বাধা নাই। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উচিত এসব পরিহার করা।তাদের এটাও মাথায় রাখা উচিত-“History repeat itself “ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হওয়ার মতন কাজ কেন দেশের অন্যতম বৃহৎ এ ছাত্র সংগঠনের করতে হবে?!এর উত্তর কখনো খুঁজে পাইনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর স্যার তথা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতা যেন মৌনতা সম্মতির লক্ষণে পরিণত হয়েছে ।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত, রাজনীতির সূতিকাগার খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’- এর হলগুলি হওয়ার কথা ছিল বহুমাত্রিক ফুলের বাগান।যেখান থেকে বৃন্তচ্যুত হবেনা একটি ফুলও।দু:খ হলেও সত্য বর্তমানে বহুমাত্রিকতা তো দূরে থাক, এতপরিমানেই একমাত্রিকতার সৃষ্টি হয়েছে যে তা নষ্টপ্রায়তে পরিণত হয়েছে।এক এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারো শিক্ষার্থী হল ছাড়া হয়েছে তাদের ভিন্ন মতাদর্শের কারণে।কিন্তু, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার কথা সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই আজ তারা পরাধীন।

বিশ্বাস করুন-এর দায় আমি কখনোই ছাত্রলীগকে দেইনা।এ দায় আমার-আপনার-আমাদের।কেননা, হাজারো অন্যায় -নির্যাতনের পরো আজ আমরা চুপ।আমাদের এ ভালোবাসার ক্যাম্পাসে আমরা আমাদের মতামত-মতাদর্শ তুলে ধরতে ভয় পাই । এই দায় যতটা না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তার থেকে বেশি নিতান্তই আমরা যারা শিক্ষার্থী আমাদের। তবে কি ঝরা বকুল হয়েই পায়ের চাপায় পিষে নি:শেষ হব? নাকি বৈচিত্রতায় ভরপুর প্রেম-দ্রোহ-ভালোবাসার এ ক্যাম্পাসে রক্ত গোলাপ হয়েই ফুটব???

লেখক: শিক্ষার্থী উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ