বিশ্ব বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর জন্মদিন আজ

মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী
মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী  © ফাইল ফটো

আমিই সেরা- দাবি করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। এ দাবির সঙ্গে দ্বিমত করা মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। আলী বলতেন, ‘আমি প্রজাপতির মতো উড়ি আর মৌমাছির মতো হুল ফোটাই’। তিনি তা বাস্তবে করেও দেখিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর সেরা একশ’ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের একজন ছিলেন মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ক্লে।

ক্রীড়া জগতে তার নামটি ক্ষিপ্রতা ও শক্তিমত্তার প্রতীক। তিনি মোট ৬১টি লড়াইয়ের মধ্যে ৫৬টিতেই জিতেছেন। ৬১টি লড়াইয়ের মধ্যে ৩৭টি লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে নকআউট করে জিতেছেন। হেরেছেন মাত্র ৫ বার। ৩ বার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জয়কারী বক্সিং ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড়। ইতিহাসের ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ ক্রীড়াব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ আলীর জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে আজকের এই লেখা।

মোহাম্মদ আলী ১৭ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে আমেরিকার কেন্টাকির লুইভিলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার নাম ছিল ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র। উনবিংশ শতাব্দীর মার্কিন দাস বিরোধী রাজনীতিবিদ ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লের সম্মানে তাঁর পিতা তাঁর নাম রাখেন ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে জুনিয়র। দুই ভাইয়ের বড় ক্লের নামকরণ পিতা ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে সিনিয়রের নামে করা হয়, যা একই নামের। বাবা ক্লে সিনিয়র ছিলেন রংমিস্ত্রি। তিনি সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড রং করতেন। মা ওডিসা গ্র্যাডি ক্লে ছিলেন একজন গৃহকর্ত্রী। ক্লের দাদা ও দাদির নাম জন ক্লে ও সালি অ্যানা ক্লে। সিনিয়র ক্লে ছিলেন আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাসের বংশধর।

মোহাম্মদ আলীর উল্লেখযোগ্য উক্তি হলো, ‘অসম্ভব হচ্ছে সম্ভাবনা। অসম্ভব হচ্ছে ক্ষণস্থায়ী। অসম্ভব বলে কিছু নেই। ইচ্ছাশক্তি অবশ্যই দক্ষতার চেয়ে শক্তিশালী।’ আরো বলেন, ‘আপনার সামনে কোনো পাহাড় নেই, যেটা আপনাকে থামিয়ে দিয়েছে। এটা আসলে আপনার জুতার মধ্যে থাকা নুড়ি পাথর।’

মোহাম্মদ আলী ১২ বছর বয়সে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। লুইভিলার পুলিশ অফিসার ও বক্সিং প্রশিক্ষক জো মার্টিন প্রথম ক্লেকে বক্সিং শিখতে বলেন। সেসময় তিনি বারো বছরের ক্লেকে এক সাইকেল চোরের সঙ্গে মারপিট করতে দেখেন। এখানে প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

ক্লে প্রথম ১৯৫৪ সালে অপেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি ছয়বার কেন্টাকি গোল্ডেন গ্লাভস, দু’বার জাতীয় গোল্ডেন গ্লাভস উপাধি লাভ করেন। একবার লাভ করেন অ্যামেচার অ্যাথলেটিক ইউনিয়ন জাতীয় উপাধি। এরপর রোমে অনুষ্ঠিত ১৯৬০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে বক্সিং প্রতিযোগিতায় লাইট হেভিওয়েট বিভাগে স্বর্ণপদক লাভ করেন।

১৯৬০ সালের ২৯ অক্টোবর পেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতায় ক্লে প্রথমবারের মতো অংশ নেন। ৬ রাউন্ডে পরাজিত করেন টানি হানসাকারকে। বাসন মাজা ও ঝাঁট দেয়ার মতো কাজ করতে রাজি না হয়ে ১৯৬০ সালে ক্লে তার প্রশিক্ষক আর্চি মুরকে ত্যাগ করেন। এরপর তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন অ্যাঞ্জেলো ডান্ডিকে। এরপর থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ক্লে ১৯-০ জয়ের রেকর্ড করেন। এর মধ্যে ১৫টি জয় নকআউটের মাধ্যমে ঘটে। এ সময় তিনি টনি এস্পার্তি, জিম রবিনসন, ডনি ফ্লিম্যান, আলোঞ্জো জনসন, জর্জ লোগান, উইলি বেসমানফ, ল্যামার ক্লার্ক, ডগ জোন্স, হেনরি কুপার প্রমুখ মুষ্টিযোদ্ধাকে পরাজিত করেন। ১৯৬২ সালে আর্চি মুরকেও পরাজিত করেন তিনি।

বক্সিং রিং-ই তাকে বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি দিয়েছে। তিনি ছিলেন বর্ণবাদবিরোধী। আত্মসম্মানের যুদ্ধে মোহাম্মদ আলি নিজের সাথে কখনো কোনো আপোষ করেন নি। ১৯৬০ সালে অলিম্পিকে সোনা জেতার পর বন্ধুকে নিয়ে আমেরিকার এক রেস্টুরেন্টে খেতে যান। রেস্তোরাঁয় ঢুকতে গিয়ে বাধা পান তিনি। কারণ রেস্তোরাঁয় শ্বেতাঙ্গ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষিদ্ধ।তিনি গর্জে ওঠেন। এ কেমন আইন! মনের আক্রোশে রোম থেকে জিতে আনা অলিম্পিকের সোনার মেডেল ক্লে ওহাইও নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেন।

১৯৬৪ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি সনি লিস্টনকে পরাজিত করে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন। শিরোপা জয় করে খ্যাতির শিখরে দ্রুত পৌঁছে যান তিনি। এর কয়েকদিন পর তিনি আমেরিকান মুসলিম সংগঠন নেশন অব ইসলামে যোগ দেন।নেশন অব ইসলামের নেতা ম্যালকমের এক্সের নামানুসারে তিনি নিজের নাম রাখেন ক্যাসিয়াস এক্স। কারণ তিনি মনে করতেন তার পদবি দাসত্বের পরিচায়ক।

১৯৬৪ সালে তিনি এলিজা মোহাম্মদ ও ম্যালকম এক্সের নেতৃত্বাধীন ‘নেশন অব ইসলাম’ নামের একটি সংগঠনের সঙ্গে পরিচয়ে সূত্র ধরেই ইসলামের সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। তিনি জানতে পারেন ইসলামে নেই কোনো বর্ণ-বৈষম্যের ভেদাভেদ। এক সময় ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নাম ধারণ করেন ‘মোহাম্মদ আলী’।১৯৬৪ সালে ২২ বছর বয়সে বক্সিংয়ে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পর আল জনসম্মুখে ঘোষণা করেন তিনি নিজে ইসলাম গ্রহণ করেছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি আল্লাহ এবং শান্তিতে বিশ্বাস করি। আমি শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় ঢুকতে চেষ্টা করব না। কোনো শেতাঙ্গ নারীকে বিয়েও করতে চাই না। মাত্র ১২ বছর বয়সে আমাকে খ্রিস্টান বানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন আমি বুঝতে পারিনি আমি কি করছি। আমি এখন আর খ্রিস্টান নই। আমি জানি আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি সত্য কী তা জানি। তোমরা আমাকে যা বানাতে চাও আমাকে তা হতে হবে না। আমি যা হতে চাই সে ব্যাপারে আমি আজ মুক্ত।’

আলী ১৯৬৬ সালে ক্লিভল্যান্ড উইলিয়ামসের সঙ্গে লড়াই করেন। এটি তার সেরা ম্যাচগুলোর একটি। এ ম্যাচে তিনি ৩ রাউন্ডে জেতেন। ১৯৬৭ সালে তিনি হিউস্টনের একটি রিংয়ে এরনি তেরেলের সঙ্গে লড়াইয়ে নামেন। তেরেল তাকে ম্যাচের আগে ক্লে বলে অপমান করেন। আলী তাকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার মনস্থির করেন। ১৫ রাউন্ডের এ লড়াইয়ে তিনি তাকে রক্তাক্ত করেন। অনেকে মনে করেন, আলী ইচ্ছা করেই লড়াই আগে শেষ করেননি।

ক্লে ইসলাম গ্রহণের পর জানতে পারেন ‘নেশন অব ইসলাম’ যদিও ইসলাম নামটি ধারণ করেছেন, তথাপিও তারা শুধুমাত্র ইসলাম নিয়েই কাজ করেন না বরং তারা আরেক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যেখানে ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মকে সমন্বয় করে আরেক ধর্মমত প্রতিষ্ঠায় নিমগ্ন তারা।

অবশেষে ১৯৭৫ সনে তিনি ‘নেশন অব ইসলাম’-এর সংস্পর্শ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করে সুন্নি মুসলিম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। শুরু করেন পুরোপুরি ধর্মীয় জীবন-যাপন। এরপর থেকেই নিজেকে প্রকৃত মুসলিম দাবি করেন।

ওই সময় তিনি বলতেন, ‘আমাকে যদি ‘ইসলাম এবং বক্সিং’ এ দুটোর মধ্য থেকে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়; তবে আমি ইসলামকেই বেছে নেবো। তিনি আমৃত্যু মানুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও ভেদাভেদ নির্মূলে শান্তির লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।

১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামে বোমা ফেলছে আমেরিকা। ডাক এলো মোহাম্মদ আলীরও, যেতে হবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। মোহম্মদ আলী ক্লে ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেন এবং যুদ্ধে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ইতিহাসে সম্মানীয় হয়ে আছেন। সে সময় আমেরিকা সরকার তাকে দোষী সাব্যস্ত করে বক্সিং উপাধি কেড়ে নেয়। আলী তাঁর জীবনের সেরা সময়ে পরবর্তী চার বছর কোনো ধরনের বক্সিং প্রতিযোগিতায় নামতে পারেননি।সরকারের কড়া আদেশ সত্ত্বেও তিনি বলেছিলেন, আমেরিকান সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে তিনি যাবেন না। তিনি এই যুদ্ধ সমর্থন করেন না।

১৯৭৫ সালে আলী লড়াই করেন ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে। দু’জন বীরের এ লড়াইয়ের জন্য সবাই খুবই উত্তেজিত ছিলেন। ১৪ রাউন্ডের শেষে ফ্রেজিয়ারের কোচ তাকে আর লড়াই করতে দেননি। কারণ তার এক চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর কিছুদিন পরই ফ্রেজিয়ার অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৭৮ সালে আলী ১৯৭৬-এর অলিম্পিক মেডালিস্ট লিয়ন স্ফিংক্সের কাছে খেতাব হারান। তিনিই প্রথম যিনি একজন অপেশাদারের কাছে হেরেছিলেন। ১৯৭৯ তিনি অবসর গ্রহণ করেন।তিনি ১৯৮০ সালে আবার ফিরে আসেন ল্যারি হোমসের কাছ থেকে শিরোপা ছিনিয়ে নিতে। ল্যারি ছিলেন তারই শিষ্য। তাই সবাই লড়াইটি নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। ১১ রাউন্ড পর আলী পরাজিত হন। পরে জানা যায় মস্তিষ্কে মারাত্মক ত্রুটি ধরা পড়েছে। তার মস্তিষ্ক ফুটো হয়ে গিয়েছিল। পরে তিনি ১৯৮১ সালে পুরোপুরি অবসর গ্রহণ করেন।

‘যদি স্বর্গ দেখতে চাও, তাহলে বাংলাদেশে এসো’। উক্তিটি করেছিলেন কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ক্লে।১৯৭৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি ৫ দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফরসঙ্গী ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী ওই সময়ের বিখ্যাত মডেল ভেরোনিকা পরশে, মেয়ে লায়লা আলী, ভাই, বাবা ও মা।

কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে একই রিংএ নেমেছিলেন প্রথম আন্তর্জাতিক পদকপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মুষ্টিযোদ্ধা আবদুল হালিম। সেদিন আবদুল হালিমকে নকআউট করেননি তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী। তিনি আরও ছোট কাউকে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে মজা করার জন্য। তখন বাংলাদেশের জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ১২ বছর বয়সী গিয়াস উদ্দিন তাঁর সঙ্গে বক্সিং খেলার সুযোগ পান।

সেই সফরে বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। ঢাকার পল্টনের বক্সিং স্টেডিয়ামের নাম তাঁর নামে নামকরণ করা হয়। মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যদি আমাকে বের করে দেয় দু:খ নেই বাংলাদেশে আমার আর একটি ঘর আছে।’ মোহাম্মদ আলী ৩২ বছর পারকিনসন্স রোগে ভোগার পর ০৩ জুন, ২০১৬ সালে ৭৪ বছর বয়সে ইহজগতের মায়া ছিন্ন করে পরপারে পাড়ি জমান।


সর্বশেষ সংবাদ