বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে মুজিববর্ষ লাগে না

আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুল  © ফাইল ফটো

আমি বাবা হয়েছি প্রায় একযুগ আগে। এরপর থেকে যখনি কোন মামলায় পড়েছি বা কোন ঝামেলায়, মনে হতো হায় হায়, আমি না থাকলে কি অবস্থা হবে আমার সন্তানদের। শীলাকে বিয়ে করার পর মনে হতো আমি জেলে গেলে বাচবে কিভাবে সে! আমাদের মতোই ভালোবাসাময় সংসার ছিল বঙ্গবন্ধুর।

উনার সাথে রাসেল, অল্পবয়সী হাসিনা, রেহানা আর উনার স্ত্রীর ছবি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, বুকের ভেতর নরম নদী উথলে উঠে। আর ভাবি, আহারে কেমন করে তিনি এদের রেখে বছরের পর বছর জেলে থেকেছেন? কিভাবে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন পথে প্রান্তরে, সংসার থেকে বহুদুরে? দেশের জন্য কি গভীর প্রেম আর মায়া থাকলে করা যায় এমন অচিন্ত্যনীয় আত্নত্যাগ! কিছু ভুল তিনি করেছেন জীবনের শেষপ্রান্তে। কিন্তু কোন ভুলেই নাকচ হয়ে যায়না তার প্রায় পুরো জীবনের অসীম আত্নত্যাগ। কোন কিছু্ আড়াল করতে পারেনা এই সত্য যে আমার দেশটা স্বাধীন হয়েছে উনি জন্মেছিলেন বলে।

২.
বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি সাধারণ বিচারবুদ্ধি থেকে। গণপরিষদ বিতর্ক পড়ে উপলদ্ধি করেছি সব আত্নত্যাগ তিনি করেছেন স্রেফ সাধারন মানুষের কষ্ট দূর করার জন্য। উনার অসমাপ্ত আত্নজীবনী পড়ে এটা আরো ভালোভাবে জেনেছি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ভারী হয়েছে বারবার। মনে হয়েছে এ বইয়ের লাইনের পর লাইন বলে আসি বাংলাদেশের সব শিশুর কাছে, তরুণের কাছে। নিথর রাতে এটাও কখনো মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুকে আমরা উপলদ্ধি করতে পারিনি ঠিকমতো। না তার বিরোধীরা, না তার স্তাবকের পাল, না তার নিজের প্রতিষ্ঠিত দল।

৩.
আমার এ মনে করাটা দৃঢ়তর হয়েছে মুজিববর্ষ পালনের বিষয়টা দেখে। উনাকে স্বরণ করা হচ্ছে অনেকাংশে স্থুল, ব্যয়বহুল, আর আরোপিতভাবে। এসব করে কি মানুষের মনে উনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জাগবে নাকি মানুষ বিরক্ত হয় উঠবে-মনে হয়না তা বিবেচনা করা হয়েছে ভালো করে।

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতের রাত বারোটা-একটায় শ্লোগান ওঠে বঙ্গবন্ধুর নামে। ভাবি, উনি বেঁচে থাকলে কি পছন্দ করতেন এটা? আমার এলাকায় সবচেয়ে অত্যাচারী মানুষটা চোখ রাঙ্গান মুজিববর্ষের পোস্টার-ব্যানারে। আমার সড়কের বহু সবুজ ঢেকে গেছে উনার নামে করা বিকট তোরণে। আমার বাসায় পত্রিকার পর পত্রিকা ঢেকে গেছে অনাবশ্যক স্তুতিবাক্যে। উনার কি ভালো লাগতো এসব?

৪.
আসল বঙ্গবন্ধুকে আমরা বোধহয় মেরে ফেলেছি মুজিববর্ষেও। আসল বঙ্গবন্ধু এসবের চেয়ে অনেক সুন্দর, অনেক মহান, অনেক মানবিক, অনেক মঙ্গলময়। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে মুজিববর্ষ লাগে না। শুধু একটু জানতে হয়, থাকতে হয় সামান্য বিচারবুদ্ধি। মুজিববর্ষের অনেক আয়োজনে সে বিচার বুদ্ধিই হারিয়ে গেছে যেন।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)


সর্বশেষ সংবাদ