একজন শিক্ষকের ক্লাসে ফেরার আকুতি, বধির প্রশাসন

মো. আবু রায়হান
মো. আবু রায়হান  © টিডিসি ফটো

বিশ্ববিদ্যালয় হলো মুক্তবুদ্ধি চর্চার লালনক্ষেত্র। একথাটি এখন স্লোগান ও বাক সর্বস্ব। কাগজে কলমে শোভাবর্ধক। বাস্তবে কাজির গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই এমন অবস্থা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন মুক্ত বুদ্ধিচর্চার চেয়ে দলদাস, দলকানা শিক্ষকদের তৈল মর্দন আর স্তুতির প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকরা হয়েছেন আজ ক্ষমতার পূজারী। শিক্ষকতার চেয়ে পদলেহন করা, পদ পদবী অর্জন তাদের বেশি দরকারী। এজন্য নিজেদের বিবেক বুদ্ধির বিসর্জন, সহকর্মীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে ,তাকে ঠেকিয়ে রাখা তাদের যেন পেশায় পরিণত হয়েছে ।

জার্মান-সাহিত্যের অহংকার ও অলংকার গেটে বলেছিলেন, “যিনি প্রতিভাবান তিনি নিশ্চয় সত্যের পূজারী হবেন।” আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের এক শ্রেণীর শিক্ষকেরা প্রতিভাবান কিন্তু অনেকে মিথ্যার পূজারী হয়ে আছেন। তাদের কাছে সত্য মানে আতঙ্ক,স্বার্থ বিরোধী কিছু।যেহেতু এদেশে “ উচিত কথার ভাত নাই।”তাই এক শ্রেণীর শিক্ষক নামে জাতি গড়ার কারিগর জীবন জীবিকার তাগিদে ও বাড়তি সুখের আশে মোসাহেবী করছেন। কিন্তু তা কতটা নীতি নৈতিকতা সম্পূর্ণ তা তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবছেন না।অথচ জাতি তাদের কাছ থেকে সঠিক দিক নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকে। তাদের বিবেক বুদ্ধির পচন সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য অশনি সংকেত। রবীন্দ্রনাথের কবিতার মর্মার্থ বুঝিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন,
" সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।"

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদি ব্যাপক ভাবে আলোচনায় এসেছেন। তার ছবি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে রুশাদ ফরিদি হাতে লেখা একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের সামনে অবস্থান নিয়ে আছেন। তার প্ল্যাকার্ডে লেখা "আমি শিক্ষক, আমাকে ক্লাসে ফিরে যেতে দিন।" তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে উল্লেখ করা হয় যে, শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহার করার কারণে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।

তবে শিক্ষক রুশাদ ফরিদির দাবি ২০১৭ সালের ৭ই জুলাই বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকায় তার একটি লেখা ছাপা হয়, যেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যপ্রণালী ও নেতৃত্বে থাকা শিক্ষকদের সমালোচনা করেন। এছাড়া তিনি ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ২০১৭'র মার্চ পর্যন্ত তিনি অর্থনীতি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যানকে সাতটি চিঠি লেখেন। বিভাগের শিক্ষকদের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে বিভিন্ন অনিয়ম ছিল তার চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু। সেসব চিঠিতে তিনি 'দূর্নীতিগ্রস্থ', 'দুমুখো' এর মত কড়া কিছু শব্দ ব্যবহার করেন। রুশাদ ফরিদির ধারণা পত্রিকায় তার লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর এবং চিঠির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও কিছু শিক্ষক তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়।

এ ঘটনার সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ড. রুশাদ ফরিদিকে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই তাকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটিতে পাঠানোর চিঠি দেয় সিন্ডিকেট। সাবেক ভিসি আরেফিন সিদ্দিক বর্তমান প্রশাসনের জন্য কিছু জঞ্জাল রেখে যান। যা বর্তমান প্রশাসনের কাজকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ ও স্থবির।

রুশাদ ফরিদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক সপ্তাহের মধ্যে আদালতে রিট করেন।দুই বছর বিচারিক প্রক্রিয়া চলার পর ২০১৯ সালের ২৫ অগাস্টে হাইকোর্ট রুশাদ ফরিদির পক্ষে রায় দেয় এবং তাকে কাজে যোগদান করার নির্দেশ দেয়।তবে আদালত অগাস্ট মাসে রায় দিলেও সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি না পাওয়ায় রায়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ সহ আইনজীবীর সনদপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রুশাদ ফরিদি ২১শে নভেম্বর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেন। রুশাদ ফরিদির অভিযোগ, ২১শে নভেম্বর নিজ বিভাগে আইনজীবীর সনদপত্র জমা দিয়ে যোগ দিতে গেলে অর্থনীতি বিভাগ থেকে তাকে জানানো হয় যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি না দিলে বিভাগে যোগদান করতে পারবেন না তিনি।

রুশাদ ফরিদির অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও তার বিভাগের কিছু শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে হয়রানি করছেন।আদালতের আদেশ পাওয়ার পরও তাকে ক্লাস নিতে না দেওয়ায় প্রতিবাদস্বরুপ গত কয়েকদিন ধরে বিভাগের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন তিনি।বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রুশাদ ফিরিদিকে ক্লাসে ফিরতে না দিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুতর অপরাধ করেছেন।

প্রথমত : রুশাদ ফরিদিকে যোগদানে বাধা দিয়েমাননীয় আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে আদালত অবমাননা করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিধান অনুযায়ী কোনও শিক্ষককে ৯০ দিনের বেশি বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নিয়ম নেই। তবে অর্থনীতি বিভাগের সহকারী শিক্ষক রুশাদ ফরিদীকে আড়াই বছর ধরে ছুটিতে রাখা হয়েছে।
তৃতীয়ত:তাকে বিভাগে যোগদান করতে না দেওয়া ও তাকে শাস্তি প্রদান মুক্ত বুদ্ধিচর্চা ও বাক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপের শামিল।যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের লংঘন।

আজ দেশে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোত সত্য উচ্চারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শিক্ষকদের দলাদলি লাল নীল হলুদে বিভক্ত এর অন্যতম কারণ। বাক স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে পড়ছে, জনমনে সত্য উচ্চারণে ভীতি কাজ করছে ।কিছুদিন আগে ঢাবির শিক্ষক আবম ফারুকের পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধের চারটি নমুনাতে পরীক্ষাগারে এন্টিবায়োটিকের সন্ধান মিলে, একথা প্রকাশিত হবার পর এ নিয়ে একটি মহল অহেতুক বিতর্কের সূচনা করে। এতে আবম ফারুকের ওপর নানান প্রকার হুমকি নেমে আসে। যদিও পরবর্তীতে তার পরীক্ষা সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়েছে। এধরনের হুমকি ধামকি স্বাধীনভাবে কাজ করার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। যদিও সেসময় আবম ফারুকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষক সমাজ। কিন্তু আজ রুশাদ ফরিদির পাশে তারা নেই কেন?

রুশাদ ফরিদিকে ক্লাসে ফিরে যেতে আদালত নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু বিভাগের নোংরা রাজনীতির কারণে তিনি এখন পর্যন্ত ক্লাসে ফিরতে পারছেন না। পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে এ ধরনের নজির আছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। একজন শিক্ষককে তার মূল কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুর্বল। এমনকি অভিযোগগুলোর তদন্ত ছাড়াই তাকে বেআইনিভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এখন কথা হলো একজন শিক্ষকের যে মূল কাজ ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া, সেটি যেন তিনি করতে পারেন সেই সুযোগ করে দেওয়া।ঢাবির বধির প্রশাসনের উচিত রুশাদ ফরিদির ক্লাসে ফেরার আকুতি নজরে নিয়ে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করা।সবশেষে জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায় বলি- "চক্ষে জ্বলুক জ্ঞানের মশাল, বক্ষে দেশপ্রেম।"

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ