বাতাসে ধুলার রাজত্ব, দিনের কুয়াশায় জীবনের ধোঁয়াশা

এম.এস.আই খান
এম.এস.আই খান  © টিডিসি ফটো

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ও বিষাক্ত বাতাস এখন ঢাকার পরিবেশে। ফলে জীবনরক্ষাকারী যে অক্সিজেন মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসে নিয়ে থাকে সেখানে এখন বিষ নিতে শুরু করেছে রাজধানীবাসি। এই ভয়াবহ দূষণের পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের নীরবতা দেখে প্রশ্ন জাগে কত মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরে মারা গেলে টনক নড়বে?

কত প্রাণ দরকার মুক্ত বাতাস কিনতে? কবি আল মাহমুদ তার একুশের কবিতা’য় লিখেছিলেন, ‘রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে মুক্ত বাতাস কিনতে’ স্বাধীনতা বুঝাতে লেখা ওই লানটি আজ যেন আক্ষরিক অর্থে ধরা দিয়েছে ঢাকাবাসীর জীবনে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি এবং তা থেকে সৃষ্ট ধূলি দূষণ নিয়ন্ত্রণে উদাসীনতা এই সংকটকে মারাত্মকরূপ দিয়েছে।

সারা দেশের মানুষের কাছে শীতকাল বলতেই মানসপটে ভেসে ওঠে রাতের কুয়াশার দৃশ্য। কিন্তু দখলে দূষণে আর অনিয়মে কুলষিত নগরী ঢাকার নাগরিক জীবন দিনের বেলায়ও ডুবে থাকে ধোঁয়াশায়। ধুলার কুয়াশায় অতিষ্ঠ নগরবাসীকে চলতে হয় মাস্ক ব্যবহার করে। নগরবাসীকে নাক-মুখ ঢেকে চলতে হলেও কর্তৃপক্ষের মুখ তাতে কতটা মলিন সেই প্রশ্নই এখন সামনে এসেছে।

ধুলিদূষণ থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বয়স্ক এবং শিশুরা। অনেকের সর্দি-কাশি লেগেই থাকছে, নানা ধরনের রোগ ছড়াচ্ছে। ধুলার সঙ্গে নানা ধরনের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ায় জনস্বাস্থ্যের সরাসরি ক্ষতি হচ্ছে। রাস্তার পাশের দোকানের খাবারে ও ফুটপাতের খাবারে ধুলা মিশে যাচ্ছে। ধুলার সঙ্গে মিশছে নানা ধরনের রোগ জীবাণু।

চিকিৎসকদের মতে, এর ফলে আমাশয়, ডায়রিয়া ও পেটের পীড়াসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। দূষিত বায়ু একজন মানুষকে অসুস্থ করে দেয়। যা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। বায়ুদূষণের ফলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এ থেকে ক্যান্সার ও শ্বাসজনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগ ছাড়াতে পারে। দূষিত বায়ু ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্রম কমিয়ে দেয়। অ্যালার্জি সমস্যা, নিউমোনিয়া, হাঁপানি ও শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। সর্বোপরি, বহু মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় এ বায়ুদূষণ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের দেওয়া এক তথ্য মতে, ধূলিদূষণের ফলে পরিবার প্রতি গড়ে পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। যে এলাকায় ধুলার পরিমাণ বেশি সেখানে একটা কাপড় একবার পরার পরই ময়লা হয়ে যাচ্ছে। ফলে অতিরিক্ত পানি খরচ হচ্ছে, অতিরিক্ত ডিটারজেন্ট যাচ্ছে, ঘনঘন কাপড় ইস্ত্রি করতে হচ্ছে। একটা কাপড় ঘনঘন ধৌত করলে দ্রুত কাপড়টি ফ্যাকাসে হয়ে যায়, ফলে নতুন কাপড় কিনতে হয়। ধুলা জমে আসবাবপত্র দ্রুত নষ্ট হচ্ছে, যন্ত্রপাতি অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বায়ু দূষণের ফলে সৃষ্ট রোগ ও অসুস্থতার কারণে ওষুধ ও চিকিৎসা বাবাদও বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হচ্ছে।

সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ঢাকার দুই কোটি মানুষ ও তাদের পরিবারের মোট অংকটা তাহলে কত বিপুল পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে। যে সমস্ত এলাকায় ধূলিদূষণ বেশি সেখানে মানুষকে মাস্ক ব্যবহার করে চলাচল করতে হচ্ছে। ঘনঘন ঘর, মেঝ, আসবাবপত্র পরিষ্কার, জামা কাপড় পরিষ্কার করার জন্য অধিক সাবান প্রয়োজন হচ্ছে এবং তা বাবদ বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। এই কাজে অতিরিক্ত শ্রমঘণ্টাও ব্যয় হচ্ছে। যার প্রকৃত আর্থিক হিসাব বেশ বড়।

বায়ু দূষণ পুরোপুরি রোধ করা হয়ত সম্ভব নয়। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ বা দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা তো তো অসম্ভব নয়। বর্তমানে ঢাকা শহর ধুলা দূষণে ছেয়ে গেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ ধুলা নিয়ন্ত্রণের কোন পদক্ষেপ না নিয়েই সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি কিংবা বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ চলছে। কোথাও কোথাও কাজ শেষ হলেও বালু, মাটি, সুরকিসহ অন্যান্য ময়লা অপসারণ না করায় সেখান থেকে ধুলা ছড়াচ্ছে।

প্রতিদিন শহরের রাস্তাগুলো যদি ভিজিয়ে দেওয়া হত তাহলে ধুলার অত্যাচার মানুষকে এতটা নাভিশ্বাস করে তুলতে পারত না। কোথাও কোথাও ভিজানো হলেও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে হচ্ছে না। ফলে ধূলি দূষণের মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। প্রতি দুই বা তিন ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা গেলে নগরবাসী বড় ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির হাত থেকে বেঁচে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক
মেইল: msikhan717@gmail.com


সর্বশেষ সংবাদ