আসামে এনআরসি এবং বিজেপির মুসলিম হটাও নাটক

আবু রায়হান
আবু রায়হান  © সংগৃহীত

ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত একটি রাজ্যের নাম আসাম। এই রাজ্যে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নিয়ে চলছে দীর্ঘদিনের বিতর্ক। সেই বিতর্কে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিককালে করা এনআরসি বাতিল করা নিয়ে। মূলত এনআরসি হলো ভারতের আসামে থাকা বাঙালিদের বিতাড়ন করার কৌশল মাত্র।

তাদের মধ্যে মূল এবং নির্ভুল টার্গেট হলো বাঙালি মুসলমানরা। আসামের প্রধান ধর্মগুলো হল হিন্দুধর্ম ৬২.৯ শতাংশ,  ইসলাম ৩৪.৯ শতাংশ এছাড়া অন্যান্য ধর্মের মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টান ধর্ম ৩.৭ শতাংশ,  শিখ ধর্ম এক শতাংশ এবং বৌদ্ধ ধর্ম ইত্যাদি।

ভারতে প্রথম এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি হয়েছিল আসামে ১৯৫১ সালে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত পর্যন্ত যারা বা যাদের উত্তরসূরীদের নাম আসামের ভোটার তালিকায় ছিল তারা এনআরসিতে স্থান পাবেন বলে বলা হয়েছিল। তাদের মতে এবারের এনআরসিতে ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে যোগ্য ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল।

১৯৫১ সালের এনআরসিতে যাঁদের নামছিল তারা এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম সর্বশেষ এনআরসিতে স্বাভাবিকভাবেই স্থান পাবেন বলে জানানো হয়েছিল। ১৯৮৫ সালের রাজীব গান্ধী এবং আসাম আন্দোলনের অন্যতম শক্তিগুলোর মধ্যে আসাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর এনআরসি নতুন করে আলোচনায় আসে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালে আসাম রাজ্য সরকারকে এনআরসি প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশ দেয় এবং ২০১৫ সালে সুপ্রিমকোর্টের তত্ত্বাবধানে আসামে এনআরসি শুরু হয়।

গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী মুসলিম বাঙালিদের বিতাড়িত করার লক্ষে নতুন করে এনআরসির জন্ম হয়। এনআরসিকে স্বাগত জানিয়ে আসাম রাজ্যের অসমীয় ও বাঙালি হিন্দুরা আনন্দ মিছিলও বের করেছিল। আসামের ইতিহাসে এনআরসির দামামা বাজিয়ে বিজেপি সরকার স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়ে রাজ্যে সরকার গঠন করে।

এনআরসি করতে গিয়ে গত চার বছরে ভারত সরকারের এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে । যা কার্যত জলে গিয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কেননা আসামের এনআরসি বাতিল করে সমগ্র ভারতেবর্ষে  নতুন করে এনআরসি শুরু করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। গত বছর এনআরসিতে মোট আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৩০ লাখ ২৭ হাজার ৬৬১ জন।

গত বছর প্রকাশিত খসড়া এনআরসি তালিকায় প্রায় ৪১ লাখ লোকের নাম বাদ পড়েছিল। তার মধ্যে প্রায় চার লাখ মানুষ তালিকায় নাম তোলার জন্য পুনর্বিবেচনার আবেদন করেননি। ফলে চলতি বছরের  ৩১ অগাস্ট চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশিত হয়ে সেই তালিকায়  চার লাখ মানুষসহ মোট ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়ে।

বাদ পড়া নাগরিকরা এর বিরুদ্ধে রাজ্যের বিদেশী  ট্রাইবুনালে আবেদন করার অনুমতি পান। তারা বিদেশী ট্রাইবুনালে আবেদন করতে ১২০ দিন সময়ও পেয়েছিলেন। এখন হঠাৎ করে এনআরসি বাতিল ঘোষণা করার সংবাদে সেখানকার মানুষেরা আপাতত স্বস্তিতে।

বাদ পড়া ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের মধ্যে  ১১-১৪ লাখেরও বেশি বাঙালি হিন্দু, যারা বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের তাড়াতে অসমীয় হিন্দুদের সাথে এনআরসি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনে নেমেছিলেন। দু:খজনক হলেও সত্য এই যে, তালিকা প্রকাশের পর ৫০ জনেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন যাদের ৪০ জনই আসামের বাঙালি হিন্দু।

হঠাৎ এনআরসি বাতিল নিয়ে বিজেপি কেন তৎপর? কারণগুলো হলো - 

প্রথমত: বিজেপি সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে জানিয়েছেন, তারা সারাদেশে নতুন করে এনআরসি করবেন, আসামেও নতুন করে এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হবে। আসামের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাও বলেছেন, আসামের এনআরসি বাতিল করে সারা দেশের সঙ্গে আসামকেও নতুন করে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।

দ্বিতীয়ত: সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে আসামে হওয়া এই এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকায় বাদ পড়া ১৯ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ১১ থেকে ১৩ লাখ হিন্দু। তালিকা প্রকাশ হতেই অস্বস্তিতে পড়ে শাসক দল বিজেপি। এতো সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠীকে দেশ ছাড়া করতে গিয়ে বিজেপিই এখন চাপে। বরং আসামের এনআরসি বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়েছে। 

তৃতীয়ত: আসামের এনআরসি সঠিক প্রক্রিয়ায় হয়নি এই যুক্তিতে সরব হয় বিজেপি। এনআরসিতে বেশিরভাগ হিন্দুদের নাম বাদ পড়ায় ভোট ব্যাংকে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে শীর্ষ নেতৃত্বকে জানায় আসাম বিজেপি। চাপ বাড়ছিল হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার থেকেও।

চতুর্থত: কোন বছরের কোন তারিখের ভিত্তিতে এনআরসি শুরু হবে তা এখনও ঠিক হয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুক্তি, আসামে এনআরসি হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। আসাম চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চকে এনআরসি তৈরির ভিত্তিবর্ষ বলে ধরা হয়েছিল।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভবিষ্যতে দেশের সব রাজ্যে যখন এনআরসি’র কাজ শুরু হবে, তখন অতীতের একটি নির্দিষ্ট দিনকে ধরে তার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি হবে। তবে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ ভিত্তিবর্ষ হচ্ছে না। তাই মন্ত্রণালয়ের যুক্তি, একদেশে দু’টি ভিত্তিবর্ষ হতে পারে না। সেজন্য গোটা দেশে যে ভিত্তিবর্ষ ধরা হবে, সেটির হিসাবে আসামেও নতুন তালিকা তৈরি করা হবে।

পঞ্চমত: আসামের এনআরসি রাজ্য সরকারের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিজেপি জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ এতে বাদ দেওয়া উচিত এমন বহু মানুযের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং পাশাপাশি বহু প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকরা বাদ পড়েছেন। রাজ্য সরকার এবং বিজেপির রাজ্য শাখা চূড়ান্ত এনআরসি নিয়ে তাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করেছে। ফলে আসামের এনআরসি এখন বাতিলের পথে।

ষষ্ঠত: ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আফগানিস্থান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আসা এই দেশগুলোর ছয়টি সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে বিশেষ ছাড় দেবার কথা বলা হয়েছে বিলে। এই বিল এনআরসির কার্যক্রমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে।

প্রকৃতপক্ষে এনআরসির মাধ্যমে মুসলিম খেদাও বিজেপির মূল লক্ষ্য। কিন্তু বিজেপির জন্য এটি বুমেরাং হয়েছে। যে কারণে এনআরসি বাতিল করা হচ্ছে। নতুন এনআরসি অবশ্যই মুসলমানদের টার্গেট করে করা হবে বলে মনে হচ্ছে। ২০০৪ সালের ১৪ জুলাই  সংসদে ভারতের  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন ২০০১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের খতিয়ান অনুসারে ভারতে এক কোটি ২০ লাখ অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছেন, যার মধ্যে ৫০ লক্ষের বাস আসামে।

৩১ অগাস্ট রাজ্য বিজেপির সভাপতি রঞ্জিত দাস বলেন, ১৯৯১ সালে আসামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিতেশরঞ্জন সইকিয়া বলেছিলেন, আসামে ৩০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে। এরপর কংগ্রেসের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীপ্রকাশ জয়সওয়াল রাজ্যসভায় বলেন, আসামে ৫০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে।

এমনকি এইচ ডি দেবগৌড়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তও আসামে ৪২ লক্ষ অবৈধ বিদেশি বাসের কথা বলেছিলেন।  তাহলে তারা কী ১৯ লক্ষ সংখ্যাটা মেনে নেব? কখনোই না। এজন্যই এনআরসি নিয়ে তাদের এই অবস্থান। আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে আসামের বাংলা ভাষাভাষী বিশেষ করে বাংলাভাষী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে গিয়ে তাদের অপরাধী, ধর্ষক সন্ত্রাসী, শুকর, কুকুর- এসব বলে গালিগালাজ করা হয়েছে নানা সময়ে।

এছাড়া মুসলমানদের মিঞা, বহিরাগত, অবৈধ নাগরিক এবং অ-অসমীয়া বলে অভিহিত করা হয়। বর্তমান বাংলাদেশ আসাম সীমান্তে ভারত পুশইন শুরু করেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ আসাম সীমান্তের ২৬২ কিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সতর্ক অবস্থান ও সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ