১১ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:৩৫

ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয় বরং শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন

  © টিডিসি ফটো

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বুয়েটের কমিটি আছে, তারা যদি মনে করে বন্ধ (ছাত্ররাজনীতি)  করে দিতে পারে। এখানে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করব না। আমার প্রশ্ন হলো, শুধু বুয়েটে  ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিলেই দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কলুষমুক্ত হবে? না!

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রআন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন অনেক বড় বড় রাজনৈতিক
নেতা। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন নমনীয় ও ক্ষণজন্মা
ছাত্রনেতা। জনগণের সেবা করতে গিয়ে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার জেল খাটতে
হয়েছে তার। অথচ বর্তমানে অনেককেই দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে রাজনীতির নামে  অপরাজনীতি করে অন্যকে প্রহার করে শিক্ষাঙ্গন ও পাড়া-মহল্ল­া, নগরে-বন্দরে আধিপত্য বিস্তার,  চাঁদাবাজি, দরপত্র ছিনতাই, ঠিকাদারি বেচা-কেনাসহ নানা অপরাধে মেতে ওঠে। যার ফলে পুরো ছাত্র  সংগঠন কলুষিত হয় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও  ছাত্রসংগঠন থেকে তারাই বহিষ্কার এমনকি জেলে রাতযাপন করে।

বঙ্গবন্ধুর লেখা “বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী” ও “কারাগারের রোজনামচা” বইয়ে স্পষ্ঠভাবে উলে­খ করা  হয়েছে তার ছাত্ররাজনীতির পুরো ইতিহাস। কেবল ছাত্রসংগঠন নয় বরং দেশের প্রতিটা নাগরিকের  বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো পড়া উচিত। নয়তো আমরা কেবল রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবো। বুয়েটে কিছুদিন আগে যা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি আগামীকালও ঘটতে থাকবে। তাই ছাত্ররাজনীতি কোনো প্রতিষ্ঠানে বন্ধ কিংবা নিষিদ্ধ মানে কোনো সমাধান নয় বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কিভাবে অপরাজনীতি বিতাড়িত করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। কারন ছাত্ররাজনীতি যদি কলুষমুক্ত না হয়, আগাছামুক্ত না হয় তাহলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে যোগ্য ও সৎ নেতৃত্বে ভুগবে।

বর্তমানে অনেকেই মনে করেন, ছাত্ররাজনীতি মানে নিজেকে ফোকাস করা মাত্র। যে রাজনীতিতে নেই কোনো ভালোবাসা, নেই অপরের প্রতি সহমর্মিতা, অথচ একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখুন, অতীতে ছাত্ররাজনীতি কতোটা সমৃদ্ধ ছিল! বর্তমানে যারা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে বাংলাদেশকে ফোকাস করে যাচ্ছেন তারা কিন্তু এ ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্রআন্দোলনের মধ্য দিয়েই উঠে এসেছেন।

তবে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্ররাজনীতিতে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে আইডল মানেন। কিন্তু তারা বঙ্গবন্ধুকে বুকে লালন করে রাজনীতি করতে আসেনা। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতিতে যারা আসছেন তাদের অনেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। ফলে আমাদের মাঝে দেখা দিচ্ছে ভবিষ্যত সৎ ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃেত্বের সংকট। আমাদের মাঝে ভালোবাসার রাজনীতির প্রচুর অভাব রয়েছে, রয়েছে রাজনীতি শেখায় অনীহা।
মার্ক জুকার বার্গের ফেসবুক আবিষ্কারের পর বাংলাদেশে রাজনীতিতে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জনসেবা না করেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ফেসবুকের কল্যাণে অনেকে নিজেকে ফোকাস করার সুযোগ পেয়েছে, পেয়েছে নিজেকে পাল্টানোর সহজ মাধ্যম। মূলত এমনভাবে রাজনীতির বাঁক চেঞ্জ হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিই ভুলে যাচ্ছি। অথচ আমাদের এই জাতির নায়ক অন্যের উপকার করতে গিয়ে এবং দেশের স্বার্থে বহুবার জেলে খেটেছেন। দেশে ছাত্ররাজনীতির নীতি-নৈতিকতা ধ্বংস করা হচ্ছে নিজেদের অবাধ স্বাধীনতায়।
গত রোববার রাত ৮টায় বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ডেকে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। এরপর তাকে শেরে বাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে পিটিয়ে হত্যা করা হয় (সূত্রঃ বাংলাদেশ জার্নাল)। আমরা অনেকসময় ছাত্রসংগঠনগুলোর বিবদমান সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। দেদারছে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে আমাদের রাজনীতির মূল্যবোধটুকু হারিয়েছি আমরা। এবার রাজনীতির মূল্যবোধটুকু ফিরিয়ে আনতে হবে, অপরাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হবে।

ছাত্রসংগঠনগুলোর এমন দশা একদিনে তৈরি হয়নি, ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। ফলে ঘুরেফিরে বিতর্কের মুখে থুবড়ে পড়ছে ছাত্রসংগঠন। কেবল ছাত্ররাজনীতি নয় বরং রাজনীতির সুস্থ্য চর্চার অনুপস্থিতিতে অপরাজনীতির গ্রাস শিক্ষক সমাজেও লক্ষণীয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাই তো প্রমাণ করে ছাত্রদের শিক্ষাদান ও চরিত্রগঠনে সাহায্যদানের পরিবর্তে নিজেদের চাকরির স্বার্থ, পদোন্নয়নের স্বার্থ এবং অন্যান্য স্বার্থে এক শ্রেণির শিক্ষক কিভাবে ছাত্রদের ব্যবহার করেন। আমরা প্রায়শই দেখি, লাল-নীল দলে বিভক্ত হয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংকীর্ণ রাজনীতি করতে। যা শিক্ষাঙ্গনে মারাত্মক ক্ষতি করে, দেখা দেয় নিজেদের মাঝে বিভেদ। যার প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির স্বচ্ছতা ও সুস্থতায় শিক্ষকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে দলীয় রাজনীতি টেনে আনার প্রভাবে অনেক সময় দেখা যায় ছাত্রদের মধ্যে বিরোধ ও সংঘাত বাঁধে। তাছাড়া দলীয় প্রভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যরা অনেক সময় পদটিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। অথচ শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ দিলেও পদ আকড়ে রাখতে চান। শিক্ষার মান নয় বরং পদ ও টাকার দিকেই নজর থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাহিনি আমাদের অজানা নয়। এমন অসংখ্য উদাহারণ আছে যারা শিক্ষার দিকে মনযোগ না দিয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে নিয়ে বিভোর থাকেন। নিজের অনুগত লোকদের শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে নিয়োগবাণিজ্য করেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের রাজনীতির অবাধ সুযোগ হ্রাস এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।

এমতাবস্থায় শিক্ষাঙ্গনে চলমান পরিস্থিতি থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারেরও সতর্ক হতে হবে। তাই শিক্ষার মান, পরিবেশ নিয়ন্ত্রনে প্রয়োজন স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা। প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতেও কঠোর আইন প্রয়োগ করা যেতে পারে । এর মাধ্যমে ছাত্রসংগঠনগুলোও অপরাজনীতি থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে পারবে তেমনি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষার মান নিয়েও অহংকার করা যাবে।

লেখক:

শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস প্রতিবেদক, কুমিল­া বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইলঃ sojibbanik931487@gmail.com