আবরার হত্যার রাজনৈতিক মাত্রা ডাউনপ্লে করছে মিডিয়া

কদরুদ্দিন শিশির
কদরুদ্দিন শিশির  © ফেসবুক

আবরার হত্যার ঘটনায় মিডিয়ার ভূমিকা কেমন ছিল? আপাত দৃষ্টিতে ভাল। বলা উচিত, ‘অপেক্ষাকৃত ভাল’। নিকট অতীতে এই মাপের বিরোধী মত-দলনের বহু ঘটনায় বহুত খারাপ অবস্থা ছিল মিডিয়ার। অনেক ক্ষেত্রে ভয়াবহ অবস্থা ছিল। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আর ক্ষমতাসীন দলের ন্যারেটিভের একক আধিপত্য থাকতো কভারেজে।

বেশিরভাগ হাউজের কভারেজ, বলা ভাল ‘অবস্থান’ প্রেডিক্টেবল ছিল। এবার এর কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটছে। আনপ্রেডিক্টেবল কিছু কভারেজ হচ্ছে। ভালো কিছু রিপোর্টিং হয়েছে। কিছু অনুষ্ঠান মানুষের প্রশংসা পাচ্ছে দেখলাম।

মিডিয়ার এই আগের তুলনায় কিছুটা ভাল আচরণের ব্যাখ্যাটা মোটাদাগে করলে বলতে হবে- এটা মানবিক দিক থেকে হচ্ছে। সাংবাদিক-পুলিশ এমনকি ক্ষমতাসীন লোকজনের বেশিরভাগই এমন খুনকে মেনে নিতে পারেননি। তাদের মানবিক অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে ঘটনাটি। রাজধানী, ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, এলিট ইউনিভার্সিটি, মেধাবী ছাত্র, খুনের ধরন, ভিকটিমের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের লেইমনেস এইসব ফ্যাক্টর এই নাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।

কিন্তু হত্যাকাণ্ডটির যে মূল ফোকাস, এটির খুনের ঘটনাটির যে রাজনৈতিক মাত্রা তা ডাউনপ্লে করছে মিডিয়া।

এই খুনের পেঁছনে কারণ হিসেবে দুটি বিষয় যৌথভাবে কাজ করেছে।

প্রথমত, খুনিরা আবরারকে নানা কারণে আগে থেকে ‘বিরোধী মত’ বা ‘শক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সে অনুযায়ী তাকে আগে থেকে টার্গেট করে চোখে চোখে রেখেছে। অর্থাৎ, খুনিদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং হল, বিরোধী মত বা শক্তিকে কোনোভাবেই সহ্য করা যাবে না। তাদেরকে একদম শেষ করে দিতে হবে। এবং এই শেষ করার প্রক্রিয়ায় যারা নেতৃত্ব দেবে তারা মূল্যায়িত হবে, সাকসেস আসবে। এই ‘বিরোধী মত শেষ করে দেয়া’র বিষয়টি তাদেরকে ‘যৌক্তিক স্বাভাবিক আচরণ’ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। চলমান রাষ্ট্রীয় নীতি, আচরণ ও ব্যবস্থাপনার পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে খুনিরা এই শিক্ষা পেয়েছে। এই শিক্ষাটিই তাদের নির্যাতনকারী ও খুনি হইতে প্রধান স্টিমুলেন্ট হিসেবে কাজ করেছে।

আর দ্বিতীয়ত, তার সর্বশেষ দুই-তিনটি ফেসবুক পোস্টকে তাকে হিট করার চূড়ান্ত উপলক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করেছে। ভারত ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে যে ভারসাম্যহীনতা, এই সম্পর্কের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না তা নিয়ে কথা বলাকে ‘অপরাধ’ মনে করেছে খুনিরা। তারা যে ‘যৌক্তিক স্বাভাবিক আচরণ’ এর শিক্ষা পেয়েছে তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ দেখে, বা যে শিক্ষা তাদেরকে দেয়া হয়েছে তার আলোকে তাদেরকে কাছে মনে হয়েছে ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হওয়া-না হওয়ার আলাপ তোলাটা ‘অন্যায়’।

আবরার হত্যা ইস্যুতে নিয়ে আলাপ করতে হলে এই দুটি বিষয় আনতেই হবে- বিরোধী মত দলনে রাষ্ট্রীয় মদদ, পৃষ্ঠপোষকতা ও এমন ম্যাকানিজম তৈরি করে রাখা এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হওয়া-না হওয়ার প্রসঙ্গ। না আনলে বুঝতে হবে এটেনশন ডাইভার্ট করা হচ্ছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের মিডিয়া কভারেজে এই দুইটি বিষয় মোটাদাগে অনুপস্থিত, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিষয়টি। (দু’একটি সংবাদমাধ্যমে দু’একটি লেখা বা রিপোর্ট বা বক্তব্য হয়তো ব্যতিক্রম দেখা গেছে গত দুই দিনে)। বরং এই খুনের ঘটনাটিকে ছাত্ররাজনীতি, যাগিং, হল পলিটিক্স ইত্যাদি ন্যারো লেন্স দিয়েই বেশি দেখা হচ্ছে, দেখানো হচ্ছে মিডিয়াতে। শুধু মানবিক অনুভূতির নাড়া খাওয়ার বিষয়টি বাদ দিলে মিডিয়া আবরার কভারেজ নিকট অতীতের চেয়ে মোটেও ভিন্ন কিছু নয়।

এই সিচুয়েশনাল মানবিকতার প্রদর্শনী বেশিক্ষণ টিকবে না। উত্তেজনা কমলে মানবিকতাও নরম থেকে শক্ত হয়ে যাবে। নিকট ভবিষ্যতে সরকারি ন্যারেটিভের উপর নির্ভর করে মিডিয়া আবরার বা আবরারের মতো আনাগত ভিকটিমরা ভিলেন হয়ে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বরং ভিলেন না হলেই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার ঘটবে। সমস্যার মূলে আঘাত না করতে পারলে ডালপালা হাতিয়ে উপরি আবেগ দেখানোকে মূল্য দেয়ার কিছু নেই।


সর্বশেষ সংবাদ